আকাশপথে হঠাৎ উধাও! আজও খোঁজ মেলেনি এই রহস্যময় বিমানের
MAS 370 Mystery: এই ঘটনাটি এখনও পর্যন্ত এয়ারলাইনসের ইতিহাসে ঘটে যাওয়া সবচেয়ে রহস্যজনক ঘটনাগুলির অন্যতম।
দিনটা ছিল ২০১৪ সালের ৮ মার্চ। অন্যদিনের মতোই এই দিনেও মালেশিয়া এয়ারলাইনসের বিমান সময়মতো আসা যাওয়া করছিল। এর মধ্যে ফ্লাইট MH370 রাত্রি ১২টা বেজে ৪২ মিনিটে কুয়ালালুমপুর থেকে রওনা দেয়, গন্তব্য বেজিং। ফ্লাইটের মধ্যে উপস্থিত ২২৭ জন আরোহী, দশজন বিমান সেবিকা এবং দু'জন বিমানচালক। আছেন ফ্লাইট ক্যাপ্টেন জাহির আহমেদ শাহ, ৫৩ বছর বয়সি এই অফিসার ভীষণ অভিজ্ঞতাসম্পন্ন , দক্ষ বিমানচালক। অন্যদিকে রয়েছেন ফার্স্ট অফিসার ফারিক হামিদ।
রওনা দেওয়ার প্রথম ২০ মিনিট সব ঠিকই ছিল, বিমানটি তার নির্দিষ্ট পথ ধরে গন্তব্যর দিকেই এগোচ্ছিল। রাত্রি ১:০৮ মিনিটে দক্ষিণ চিন সাগরের ওপর দিয়ে যাওয়ার সময়ে ক্যাপ্টেন জাহির নিজের প্রথম রিপোর্টিং করেন কুয়ালালুমপুরের এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলে। এর প্রায় ১১ মিনিট পর, 'হো-চি-মিন' অর্থাৎ কুয়ালালুমপুরের এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল, ফ্লাইট MH370-এর সঙ্গে যোগাযোগ করে। 'হো-চি-মিন' থেকে রেডিও মারফত জানানো হয় 'MAS 370. Contact Ho Chi Minh. 120.9. goodnight.' প্রতুত্তরে ক্যাপ্টেন জাহির জানান, "Good Night.MAS 370." বিষয়টি শুনতে ভীষণ সাধারণ লাগতে পারে, কারণ এখনও পর্যন্ত বিষয়টি সাধারণ ও দৈনন্দিকই ছিল। কিন্তু জানলে অবাক হতেই হবে, যে ক্যাপ্টেন দ্বারা প্রেরিত এই বার্তা, আসলে MAS 370 থেকে আসা শেষ বার্তা ছিল। এরপর এই বিমানটির আর কোনও খোঁজ পাওয়া যায়নি। এটি হঠাৎ নিজের পরিচালন পথেই উধাও হয়ে যায়। বলাই বাহুল্য, এই ঘটনাটি এখনও পর্যন্ত এয়ারলাইনসের ইতিহাসে ঘটে যাওয়া সবচেয়ে রহস্যজনক ঘটনাগুলির অন্যতম।
যাত্রাপথে ভিয়েতনাম র্যাডারে পৌঁছনোমাত্র ৩০ সেকেন্ডের মধ্যে এই বিমানটি উধাও হয়ে যায়। রাত্রি ১টা বেজে ২১ মিনিটে ঘটা এই অস্বাভাবিক ঘটনাটি কুয়ালালুমপুরের এয়ার ট্রাফিকের নজর এড়িয়ে যায়। MAS 370-কে নিজেদের র্যাডারের মধ্যে না পেলে, তারা অনুমান করে নেয়, যে বিমানটি পরবর্তী র্যাডারে প্রবেশ করে ফেলেছে। অন্যদিকে সেসময়ে ভিয়েতনামের এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলারের নজরে আসে, যে MAS 370 তাদের র্যাডারের ভেতর প্রবেশ করে হঠাৎই তাদের র্যাডার থেকে উধাও হয়ে গেছে। বিষয়েটা নজরে আসতেই তারা তৎক্ষনাৎ বিমানটির সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে , কিন্ত উল্টোদিক থেকে তখন কোনও উত্তর পাওয়া যায় না। এইভাবে ক্রমাগত ১৮ মিনিট সেই বিমানটির সঙ্গে যোগাযোগ প্রতিস্থাপনের চেষ্টা চলতে থাকে, কিন্ত এত কিছুর পরেও MAS 370-এর সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পেরে, অবশেষে তারা কুয়ালালুমপুরের এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলকে খবরটি জানায়। এমতাবস্থায় কুয়ালালুমপুরের এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলের দায়িত্ব ছিল, এয়ারক্র্যাফট উধাও হওয়ার একঘণ্টার মধ্যে কোনও পদক্ষেপ করার, কিন্ত তারপর আরও ৪ ঘণ্টা কেটে যায়, কিন্ত MAS 370-এর কোনও খোঁজ পাওয়া যায় না। ভোর ৬টা বেজে ২৬ মিনিটে, বিমানটির বেজিংয়ে ল্যান্ড করার কথা ছিল, কিন্তু যথারীতি সেই এয়ারক্র্যাফটটি সেখানে পৌঁছতে পারে না।
আরও পড়ুন: ১৮ বছর ধরে বাস বিমানবন্দরেই! বাস্তবের ‘টার্মিনাল’ ম্যানের মৃত্যু অবাক করছে বিশ্বকে
বেজিংয়ে MAS 370 গিয়ে না পৌঁছলে, এয়ারলাইনসের মধ্যে চরম কোলাহলের সৃষ্টি হয়। পরিস্থিতি কবজায় আনতে ও MAS 370-এর হদিশ পেতে মালেশিয়ান এয়ারলাইনস তৎক্ষণাৎ সার্চ অপারেশন শুরু করে। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, প্লেনটি মালয়েশিয়া থেকে বেজিং-এর পথে রওনা হয়েছিল, যার মধ্যে ছিল দক্ষিণ চিন সাগর ও ভিয়েতনাম। সুতরাং, সার্চ অপারেশন শুরু হয় দক্ষিণ চিন সাগরের মাঝের অংশ থেকে। এই সার্চ অপারেশন একটি আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টা, যেখানে ৭টি আলাদা আলাদা দেশ থেকে মোট ৩৪টি জাহাজ, ২৮টি বিমান MAS 370-কে খোঁজার কাজে লেগে পড়ে। কিন্তু MAS 370-এর কোনও হদিশই পাওয়া যায় না।
ঘটনাটির প্রায় ৪ দিন পর, অর্থাৎ ১২ মার্চ একটি রিপোর্ট সামনে আসে, সেখানে বলা হয় যে, প্লেনটি সিভিলিয়ান র্যাডার থেকে উধাও হলেও সেই রাতে একটি মিলিটারি র্যাডারে এই প্লেনটির অস্তিত্ব দেখা গিয়েছিল। মিলিটারি র্যাডারের রেকর্ড অনুসারে এই বিমানটিকে শেষবার দেখা গিয়েছিল রাত্রি ২টো বেজে ২২ মিনিটে। কিন্তু এর অবস্থান ছিল দক্ষিণ চিন সাগরের আশপাশে নয়, বরং সম্পূর্ণ বিপরীত পথ, আন্দামান-নিকোবরের কাছে । এই ছোট্ট তথ্যটি সম্পূর্ণ গল্পের মোড় ঘুরিয়ে দেয়।
এর কিছুদিন বাদে এই বিষয় সম্পর্কিত আরেকটি তথ্য সামনে আসে, যেখানে জানা যায় যে, প্লেনটি আসলে একটি স্যাটেলাইটের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছিল। বিষয়েটি আরও খতিয়ে দেখা হয়, কিন্তু কোনওরকম তথ্য আদানপ্রদানের রেকর্ড পাওয়া যায় না। এরকম ছোট ছোট তথ্যগুলিকে কাজে লাগিয়ে, বিভিন্ন বিজ্ঞানী নিজ নিজ দায়িত্বে বিভিন্নরকম গবেষণা ও পরীক্ষানিরীক্ষা আরম্ভ করেন।
সেই বছর এপ্রিল মাস পর্যন্ত সমুদ্রের উপরিঅংশে এই সার্চ অপারেশন চলতে থাকে। এতে বিশেষ সুবিধা না হলে, এই অপারেশন বন্ধ করে, 'ডিপ ডাউন সি' অপারেশন শুরু হয়। এই অপারেশন পৃথিবীর অন্যতম ব্যয়বহুল অপারেশনের একটি । এই খাতে ১৬০ মিলিয়ন ডলার খরচ করার পরও কোনও সন্ধান না পাওয়া গেলে, সরকার এই অপারেশন বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়। কিন্তু এই প্রকল্পের দরুন ২০১৫ সালে জুলাই মাসে, মাদাগাস্কারের কাছে একটি ছোট্ট দ্বীপে MAS 370-এর একটি ভাঙা অংশ পাওয়া যায়। এরপর ২০১৮ সালে 'ওসান ইনফিনিটি' নামক এই বেসরকারি সংস্থা বিনা পারিশ্রমিকে এই বিষয়ে কাজ করা শুরু করে। তারা অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতিকে কাজে লাগিয়ে সেই বিমানে ধ্বংসাবশেষ খোঁজার অনেক চেষ্টা করে, কিন্তু সবশেষে অসফল হয়। কিন্তু এত বছর পর, অবশেষে চলতি বছরের মার্চ মাসে, এই MAS 370 সংক্রান্ত বেশ কিছু তথ্য পাওয়া যায়। বৈজ্ঞানিক রিচার্ড একটি রিপোর্ট পেশ করেন, যেখানে তিনি বেতার তরঙ্গকে কাজে লাগিয়ে সেই এয়ারক্র্যাফটের পুঙ্খানুপুঙ্খ অবস্থান বলে দিয়েছেন। আশা করা যাচ্ছে, খুব শিগগির সেই অবস্থানে সার্চিংয়ের কাজ শুরু হবে, এবং আট বছর আগে হারিয়ে যাওয়া MAS 370-এর হদিশ পাওয়া যাবে।