চালকের আসনে বাংলার ছেলে, চেনেন বন্দে ভারত এক্সপ্রেসের প্রথম সারথিকে?
Vande Bharat Express : ১৯৯০ সালে অ্যাসিন্ট্যান্ট ড্রাইভার হিসাবে কাজে যোগ দেন অনীল কুমার।
- দেশ জুড়ে এখন একটাই রব, ‘বন্দে ভারত’। রাজনীতির রং অবশ্য প্রথম থেকেই ছিল তবে সূচনা পর্বের স্লোগান সেই বিতর্ককে আরও খানিকটা বাড়িয়ে দিয়েছে ইতিমধ্যে। তবুও চাকা গড়িয়েছে বুলেট ট্রেনের। ফেলো করি মাখো ভোটের নীতিতে বাংলাকে এবার পীঠস্থান করেছে বিজেপি, তাই রেল পথে নয়া নিয়া সূচনা। এমনকী মায়ের মুখাগ্নি সেরেই আহমেদাবাদ থেকে পতাকা নাড়িয়েছেন নরেন্দ্র মোদি। হাওড়া থেকে নিউ জলপাইগুড়ির মাঝে নতুন এই ট্রেনটি দাঁড়াবে তিন জায়গায়। বোলপুর, মালদা টাউন এবং বিহারের বারসই। মাত্র সাড়ে সাত ঘণ্টার জার্নিতেই সফর শেষ। এহেন ট্রেনকে ঘিরে শুরুর আগে থেকে উত্তেজনা ছিল তুঙ্গে।
কিন্তু এই এত যে আয়োজন তার নেপথ্যে রয়েছে যিনি? না তিনি নিশ্চয়ই মোদী নন। নয় কেন্দ্রের কোনো নামজাদা নেতাও। তিনি আমার সবার মতো একজন সাধারণ মানুষ। পেশায় একজন লোকো পাইলট। সাধারণ হয়েও তিনি অসাধারণ। এতো আয়োজন, এত আবেগের তিনিই যে সারথি।
নাম, অনীল কুমার। বাড়ি বর্ধমান। সাধারণ মধ্যবিত্ত বাঙালি। কিন্তু এই পর্বে তিনিই নায়ক। গত শুক্রবার তখন সবে মাত্র বর্ধমান স্টেশনে ঢুকছে ট্রেন। চালকের আসনে অনীলবাবু। প্ল্যাটফর্মে তখন ঠাসা ভিড়। সকলেই অপেক্ষা করে রয়েছেন আগত নয়া ট্রেনের জন্য। কেউ কাউকে এক চুল জায়গা ছাড়তে নারাজ। আর এই ভিড়ের মধ্যেই ঠেলাঠেলির ধাক্কায় বারবার পিছিয়ে পড়ছেন খোদ চালকের স্ত্রী সুনীতা কুমার। অবশ্য তখনও তাঁর পরিচয় অজানা।
আরও পড়ুন - বোলপুরে হাজির বন্দে ভারত, ভেতরে এলাহি খাবার আয়োজন, জিভে জল আনবে এই পদগুলি
নির্ধারিত সময়ে ট্রেন ঢুকল বর্ধমান স্টেশনের এক নম্বর প্ল্যাটফর্মে। শুরু হল বন্দে ভারতের সঙ্গে সেলফি তোলার হিড়িক। অথচ এসব ভ্রুক্ষেপ নেই সুনীতার। তাঁর চোখ তখন খুঁজছে স্বামীকে। ঠিক এরকম সময় হঠাৎই চালকের আসনের ঠিক পাশের জানলার কাঁচটা নেমে গেল। আর সেখান থেকেই স্বয়ং সারথি অনীলবাবু হাত নাড়িয়ে দিলেন স্ত্রীর দিকে। নিমেষে বদলে গেল প্ল্যাটফর্মের ছবিটা। স্ত্রীর চোখের কোণ ভিজে গেল অজান্তেই। আনন্দ আর গর্বের মিশেল বোধ হয় এরকমই হয়।
আদতে বিহারের বাসিন্দা হলেও অনীল কুমার বর্তমানে স্বপরিবারে বর্ধমানের লোকো সারদাপল্লীতে থাকেন। তাই বর্ধমান ঘিরে একটা অন্য আবেগ রয়েছেই। এরাজ্যের প্রথম সেমি হাইস্পিড ট্রেন বন্দে ভারত এক্সপ্রেস শুক্রবার বর্ধমান স্টেশনে পৌঁছতেই চালক অনীলও হাতজোড় করে সবাইকে প্রণাম জানান। স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকা সাধারণ মানুষের কেউ কেউ এদিন মালা পরিয়ে বরণ করে নেন সারথিকে। আশেপাশের লোকজন স্বামীকে নিয়ে এতটা উৎসাহিত দেখে আবেগতাড়িত হয়ে পড়েছিলেন স্ত্রী সুনীতাও।
১৯৯০ সালে অ্যাসিন্ট্যান্ট ড্রাইভার হিসাবে কাজে যোগ দেন অনীল কুমার। শুরু থেকেই কর্মপ্রিয় মানুষ ছিলেন তিনি। বরাবরই লক্ষ্য ছিল দেশের সবথেকে গুরত্বপূর্ণ ট্রেনগুলো চালানো। বিভিন্ন মেল, এক্সপ্রেস চালানোর পাশাপাশি পূর্বা, কালকা, শতাব্দী, রাজধানী এমনকী দুরন্ত এক্সপ্রেসও চালিয়েছেন ইতিমধ্যেই। এবার সেই তালিকাতেই বাড়তি সংযোজন হল বন্দে ভারত এক্সপ্রেস। প্রথম চালক হিসেবে অতিরিক্ত শিরোপাটিও এবার রইল তাঁর মাথাতেই।
আরও পড়ুন - মুখাগ্নি সেরেই বন্দে ভারতের উদ্বোধন! কেন বাংলায় ৭,৮০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করল কেন্দ্র?
চলতি মাসের ৭ তারিখে বন্দে ভারত এক্সপ্রেস চালানোর জন্য স্পেশ্য়াল ট্রেনিংয়ের জন্য উত্তর প্রদেশের গাজিয়াবাদে যান অনিল কুমার। ট্রেনিং শেষে ১৯ তারিখ তিনি বর্ধমানের বাড়িতে ফিরে আসেন। সেই থেকেই দিন গুনছিলেন তিনি। দেশের এমন একটা পর্বের চাবিকাঠি যখন তাঁর হাতে তখন সে নিয়ে উত্তেজনা থাকা তো খুবই স্বাভাবিক।
এদিকে বন্দে ভারত নিয়ে তোলপাড়, বাস্তব দুনিয়া থেকে নেট মাধ্যম সর্বত্র আলোচনা পর্যালোচনার হিড়িক তখন বাংলার ট্রেনের সারথি একজন বাঙালিই, এ তো রাজ্যবাসীর কাছে বাড়তি পাওনা। স্বামীর কাঁধে এমন একটা দায়িত্বের মূল্য অবশ্য যথার্থই বোঝেন স্ত্রী সুনীতা। তাই সেদিন ভিড় ঠেলে সুবিধা পেতে সামনে এগিয়ে যাননি তিনি। বরং দূর থেকে দাঁড়িয়েই নিজের অস্তিত্বটুকু জানান দিয়েছেন। আগের দিন যখন হাওড়ার উদ্দ্যেশে রওনা দিয়েছিলেন স্বামী তখন থেকেই প্রদীপে তেল ধরে প্রস্তুত ছিলেন তিনিও। প্রদীপের শিখার আলোয় যখন স্বামী অনীল কুমার দীপ্যমান তখন প্রদীপের নিচের ওই অন্ধকারের মতোই দূর থেকে দেখতে চেয়েছিলেন সবটুকু। কিন্তু যোগ্য স্বামী অনীলবাবু, তাই নিজেই হাত নেড়ে স্বীকৃতি দিয়ে যান তাঁর এমন কর্মপ্রাণ জীবনের নেপথ্যের কাণ্ডারি তথা তাঁর স্ত্রী সুনীতা কুমারকে।