আজও সুরের মসনদের রানি লতা মঙ্গেশকর
নামজাদা সংগীত শিক্ষক দীননাথ মঙ্গেশকর। এলাকায় তাঁর বেশ কিছু ছাত্র ছাত্রী। সযত্নে সকলকে তালিম দেন, ভুল ভ্রান্তি হলে ধরিয়ে দেন। এ ছাড়াও নাট্যাভিনেতা হিসেবে রয়েছে তাঁর খ্যাতি। মারাঠি নাটক সে সময় ভারতবর্ষে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। দিন কয়েক আগে আন্নাসাহেব কিরলোস্করের আগমনের ফলে মহারাষ্ট্রের রঙ্গমঞ্চে লেগেছে জাঁকজমকের হাওয়া। তারই সুধারস পান করে দীননাথ বীরদর্পে মঞ্চে নামেন, দর্শকদের মধ্যে তারিফের বন্যা বয়ে যায়। এক দিকে অভিনয়, অন্য দিকে গান, এই নিয়ে ছিল তাঁর জীবন। অথচ দীর্ঘদিন পর্যন্ত তিনি জানতেও পারেননি যে ঠিক তাঁর মতোই তাঁর কন্যা লতাও সংগীত অন্তপ্রাণ।
লতা তখন ছোট্ট শিশু। সারা বাড়ি লাফিয়ে বেড়ান তিড়িং বিড়িং করে, আর সারাক্ষণ গুনগুন করে গাইতে থাকেন গান। দীননাথের দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী সেবন্তীর কন্যা তিনি। ছোটবেলা থেকেই বাবার দৌলতে বাড়ির দাওয়ায় শুনেছেন সুরের মাধুর্য। এমন এক মেয়ের গলায় যে অচিরেই সরস্বতী বাসা বাঁধবেন সে আর আশ্চর্য কী। তা যাই হোক, ছোট্ট মেয়ে লতার গুনগুন সুরের রেশ ছড়িয়ে থাকে গোটা বাড়ি জুড়ে। তাঁর গান শোনার মতো কেউ নেই, ফলত বাড়ির কাজে যাঁরা সাহায্য করতে আসেন তাঁদেরকেই তিনি গান শোনান। ধৈর্যের সঙ্গে তাঁদের বুঝিয়ে দেন সুরের চলন। এতে অবশ্য তাঁর মা খানিক রেগেই যান। পরিচারিকাদের কাজের সময়গুলো এইভাবে নষ্ট করে মেয়েটা। তাঁরা কাজ করবেন কখন আর মেয়ের গানই বা শুনবেন কখন। ফলত, গান গাওয়ার জন্য মাঝে মধ্যেই মাতৃদেবীর কাছে ধমক ধামক খান লতা।
আরও পড়ুন-দুঃখসাধনের নীলিমা, তাঁর চিঠিটা পৌঁছে দেওয়া হলো না…
এমনই একদিনের ঘটনা। দীননাথের শিষ্য চন্দ্রকান্ত গোখলে তাঁদের বাড়ির উঠানে রেওয়াজে বসেছেন। একের পর এক স্বর ধরে ধরে তিনি সাবধানে গাইছেন রাগ পুরিয়া ধ্যানেশ্রী। দীননাথ কিছু কাজে বাইরে গেছেন। শিষ্যকে তিনি কড়া নির্দেশ দিয়ে গেছেন, 'আমি না ফেরা পর্যন্ত যেন রেওয়াজ না থামে।' এমন সময় লতা হাজির হলেন সেখানে। চন্দ্রকান্তর দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, 'ওহে এসব কী গাইছ, এ যে ভুলভাল হচ্ছে।' চন্দ্রকান্ত তো অবাক, 'একরত্তি মেয়েটা বলে কী?' লতা তারপর নিজে গেয়ে দেখিয়ে দিলেন তিনি ঠিক কী বলতে চাইছিলেন। চন্দ্রকান্তকে যে তালিম দীননাথ দিচ্ছিলেন, তা ভেতরের ঘর থেকে একবার শুনেই তিনি ধরে ফেলেছেন। তারপর দীননাথ কাজ সেরে ফিরলেন, চন্দ্রকান্ত বিস্ময়ের দৃষ্টিতে লতার দিকে তাকিয়ে বললেন, 'তুমি তখন যেটা গাইছিলে সেটা এবার বাবার সামনে গাও।' লতা ততক্ষণে দে ছুট।
কিন্তু প্রতিভা বেশিদিন আড়ালে থাকে না। আলোর মতো সে ছড়িয়ে পড়ে দিগ্বিদিকে। আর ঠিক সেই নিয়মেই দীননাথ একদিন জানতে পারলেন লতার অপরূপ কণ্ঠস্বরের কথা। তাঁর যাবতীয় গণনা তিনি সেদিনই সেরে ফেলেছিলেন। দৃঢ় কণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন, 'এ মেয়ে বড় হয়ে এমন নাম করবে যে কেউ ওর ধারে কাছেও আসতে পারবে না।' হলও তাই। বাবার পাশাপাশি সঙ্গীতাচার্য আমান আলী খান এবং আমানত আলি খানের কাছে তালিম নিতে লাগলেন তিনি। প্রথম গান রেকর্ড করলেন ১৯৪২ সালে, 'কিতি হসাল' নামক একটা মারাঠি ছবির জন্য। যদিও পরবর্তীকালে ছবিটা মুক্তি পাওয়ার সময় লতার গান সেখান থেকে ছেঁটে ফেলা হয়।
তারপর লতাকে লড়ে যেতে হয়েছিল প্রায় সাত বছর। সে সময় বাজার দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন নূরজাহান, শমসাদ বেগমের মতো শিল্পীরা। তাঁদের গলার ওজন শুনলে আজও রীতিমত গায়ে কাঁটা দেয়। এরই মধ্যে লতা গাইতে এসেছেন জলতরঙ্গের মতো চিকন আওয়াজ নিয়ে। একদল মানুষ মন্তব্য করলেন, 'ধুস, এমন রিনরিনে আওয়াজ ধোপে টিকবে না।' কিন্তু তাঁদের ভুল প্রমাণিত করতেই এসে পড়ল ১৯৪৯ সাল। 'মহল' ছবিতে 'আয়েগা অনেওয়ালা' গানখানা গাইলেন লতা। তারপর আর তাঁকে পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। হাওয়ার গতিতে তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে সারা পৃথিবীতে। অন্তত ৩৬ টা আঞ্চলিক ভাষায় তিনি ২৭ হাজারেরও বেশি গান রেকর্ড করেছেন। ১৯৭৪ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত তাঁর বার্ষিক রেকর্ডিংয়ের সংখ্যা সর্বাধিক, এই রেকর্ড স্থান পেয়েছে 'গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ড'-এও। তিনি কাজ করেছেন নওশাদ, সলিল চৌধুরীর মতো খ্যাতনামা পরিচালকদের সঙ্গে। সুরের মায়াজালে বিশ্ববাসীকে মুগ্ধ করে পেয়েছেন 'ভারত রত্ন', 'পদ্মভূষণ' এবং 'পদ্মবিভূষণে'র মতো খেতাব।
আমরা হয়ত অনেকেই জানি না, গানের পাশাপাশি অভিনয়ের চেষ্টাও করেছিলেন লতা মঙ্গেশকর। পরিবারের অর্থনৈতিক দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতে ১৯৪৮ সাল অবধি অন্তত আটখানা ছবিতে অভিনয় করেছেন 'দ্যি নাইটেঙ্গেল অফ বলিউড'। ১৯৬২ সালে ভারত চীন যুদ্ধের সময় সি. রামচন্দ্রর সুরে 'এ মেরে ওয়াতন কী লোগো' গানটা গাওয়ার দায়িত্ব পড়েছিল তাঁর উপর। সে গান শুনে সেদিন পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু চোখের জল ধরে রাখতে পারেননি। ভাবতেও অবাক লাগে, স্বয়ং বাগদেবীর বিসর্জনের আগেই জীবনাবসান ঘটল সরস্বতীর এই মানসকন্যার।
তথ্যঋণ: Interesting Stories About Our Nightingale That Will Make You Smile: Laughing Colors