ডিয়ার পুরুষ, 'লড়কিও কি না মে হাঁ নেহি হোতি হ্যায়'
Patriarchy and Male Sensitivity: অধিকাংশই বিশ্বাস করেন, ‘মেরি বান্দি হ্যায়'। যা আমার, তাঁর থেকে আবার এত সম্মতি, জিজ্ঞাসা কীসের! শোনার অভ্যাস পুরুষদের বরাবরের কম।
পাড়ার এক পার্লারে গেছি। একজন মহিলা, তাঁর পুত্রসন্তানকে নিয়ে এসেছেন। পুত্রটি বকবক করতে ভালোবাসে, ক্লাস ফোর কী ফাইভ! সেই পুত্রের মুখনিঃসৃত বিবিধ বাক্য শুনে বোঝা গেল, ছেলে আর মেয়ে যে ভিন্ন প্রাণী এই নিয়ে তাহার সম্যক ধারণা রহিয়াছে এই কাঁচা বয়সেই। এই দুই ভিন্ন প্রাণীর মধ্যে সে পুরুষ এবং সে মেয়েদের থেকে আলাদা। ১৫ মিনিট সময়ের মধ্যে এই প্রগলভ পুত্র ১৩ মিনিট ছেলে আর মেয়ের পৃথকীকরণ করে গেল। এসব দীর্ঘক্ষণ সহ্য করা কঠিন যদিও। তাও পরের ছেলে পরমানন্দ ভেবে বড় বড় নিঃশ্বাস নিয়ে শুনছিলাম। তারপরেই সেই মোক্ষম ঘটনা! পার্লারের দিদি সেই পুরুষ পুত্রসন্তানটিকে মজার ছলে বলে ফেললেন, "যা তো, ঝাঁটাটা নিয়ে মায়ের চুলগুলো একটু বাইরে ফেলে দে!” পুরুষ পুত্রসন্তানের সে কী আস্ফালন! মুখ বিকৃত করে বীরপুরুষ-পুত্রটি বলল, “অ্যাহ! ঝাঁটা কেন দেব? ওটা তো মেয়েদের কাজ!”
'জনমদুখিনী মা' শব্দটা কেন কবি লিখেছিলেন এই পুত্রটির মায়ের সকরুণ মুখ দেখে বুঝলাম। লজ্জা-গ্লানি চেপে আমার বিস্ফারিত চোখ, মুখভরা বিরক্তি দেখে বললেন, "আসলে ওর বাবা আর শাশুড়ি মা...” বাকিটা আর বলা নিষ্প্রয়োজন! যে পুত্রসন্তান এই বয়সে ছেলের আর মেয়ের সামাজিক লিঙ্গ আলাদা করার শিক্ষা পেয়ে বড় হচ্ছে, সেই পুত্রসন্তান বাস্তবে 'পুরুষ' হয়ে চারপাশের মহিলাদের ঠিক কেমনতরো সম্মান করবে তা অনুমেয়। গোড়াতেই যা সর্বনাশ হওয়ার, অধিকাংশ পরিবারেই তা হয়ে যায়। একটি সন্তানকে অধিকাংশই হয় পুরুষ হিসেবে বড় করেন বা নারী, মানুষ নয়। মানুষ হলে, একে অন্যের সহনাগরিক হতাম। কেউ সেকেন্ড সেক্স, কেউ মরদ, কেউ তৃতীয় লিঙ্গ হতাম না। পুরুষের বড় হওয়াটা, মেয়েদের বড় হওয়াটা সমান রকমের গোলমেলে। ছোটবেলা থেকে ক্যাকটাস হয়ে জন্মানো গাছ বড় হয়ে আপেল-লিচু ফলাবে এই প্রত্যাশা করা আমাদেরই দৈন্য। শ্রেণিশত্তুর ভাবার কোনও কারণ নেই, তাও কয়েকটা ছোট্ট উদাহরণ না বললে বড়ই কামড়াচ্ছে। কখনও দেখেছেন, একদল মেয়ে জোট বেঁধে প্রজাপতির ডানা ছিঁড়ছে? কোথাও দেখেছেন, একদল মেয়ে কুকুরের ল্যাজে কালীপটকা বেঁধে ফাটাচ্ছে? কখনও দেখেছেন, তরোয়াল-কাটারি নিয়ে পেশির আস্ফালন করছে একদল মেয়ে? এই উগ্রতা, এই অসংবেদনশীলতা মেয়েদের শেখানোই হয় না। সে বেচারি ছোট থেকে বার্বিডল খেলতে শিখেছে, রান্নাবাটি, পুতুল, ফ্রক, সোনার বালা পেয়েছে অন্নপ্রাশনে। পুত্র বন্দুক পেয়ে ঢিঁচক্যাও ঢিঁচক্যাও করে নিজেকে 'রাখওয়ালা' ভাবতে শেখে। খেলনা গাড়ি নিয়ে দ্রুতগতিময়তার খোয়াব দেখে। ফুটবল, ক্রিকেট ব্যাট নিয়ে দেশ উদ্ধারের আশা জাগায়। আর হাঁটুর নীচে গোছা ভরা চুল দোলাতে দোলাতে খুকু কেবল রাঙা মাথায় চিরুণি আর পুতুলের বিয়ে দেওয়ার গণ্ডিতেই আটকে যায়।
আরও পড়ুন- যৌনাঙ্গে রড, দেহ ৩৫ টুকরো! অপরাধীকে নৃশংসতা শেখায় আসলে কারা?
যদিও ছদ্ম-লিবেরাল রসিকজনরা বলেন, আজকাল আর তেমন দিন নেই। মেয়েরাও এখন চাঁদে যাচ্ছে, প্লেন চালাচ্ছে, ট্রেন চালাচ্ছে, ব্যবসা করছে। মানে, করার তো কথা ছিল না! রান্নাবাটি, গোলাপি ফ্রক, সন্তান পালন, বরের জাঙিয়া কাচা ছাড়া তো বিশেষ কিছু করার কথাও ছিল না। অর্থাৎ নিজের সীমার বাইরে গিয়ে সে কিছু করে ফেলছে! বাকিদের দৃষ্টি তো বাঁকা হতে বাধ্য! অথচ, জন্ম থেকে সামান্য সংবেদনশীলতা শেখালেই, সহানুভূতি শেখালেই গল্পটা অন্য হতেও পারত! একই পুরুষ হস্টেলে থাকলে নিত্য রান্না, মেসিং, বাজার করে পৃথিবী উল্টে দেয়। অথচ ঘরে তাঁকে কুটো নাড়তেও দেওয়া হয় না। কন্যাটিকে জিনিস গুছিয়ে রাখার শিক্ষা দেওয়া হয়, ছেলেটি মোজা, গামছা, ছড়িয়ে রাখতে রাখতে একদিন মোক্ষম অজুহাত পেয়ে বলে ওঠে, 'ক্রিয়েটিভ মানুষরা এলোমেলো থাকে'! আর তাঁদের এই ক্রিয়েটিভিটি সামলাতে সামলাতে জনমদুখিনী মা, বোন, স্ত্রী, প্রেমিকা, বান্ধবীদের কোমরে বাত ধরে যায়।
তবে সব পুরুষ এমন নয় মোটেও। অনেকেই সংবেদনশীল হতে চান। কত কীই তো কতজন হতে চান। শাহরুখ খান হতে চেয়ে কতজনই তো মুম্বইয়ের আঁধার গলিতে হারিয়ে গেছেন। কতজনই দেশ উদ্ধার করতে চেয়ে নেতা হয়ে কোটি টাকা মেরে জেলে বা উডবার্ন বিভাগে ঢুকে গেছেন। গত এক দশকে বেশ কিছু পুরুষ দেখেছি যারা একটা কমন উপায়ে 'সংবেদনশীল' হতে চান মেয়েদের কাছে। ধরুন, আপনি বললেন পেটটা ব্যথা করছে। আপনার চারপাশে থাকা 'সংবেদনশীল' হতে চাওয়া পুরুষবৃন্দ, যারা আপনার ততটাও ঘনিষ্ঠ নয়, তারা জিজ্ঞাসা করবেন, ‘পিরিয়ডস হয়েছে?’ হয়তো মোমো, বিরিয়ানি, ফুচকা, আইসক্রিম একসঙ্গে খেয়ে পাচনতন্ত্রকে ঘেঁটে ফেলেছেন আপনি। সেই কারণেই ব্যথা, কিন্তু এই মানুষেরা পিরিয়ডসটাই জিজ্ঞাসা করবেন কারণ তাঁদের ধারণা পিরিয়ডস যেহেতু নারীদের বিষয়, এই নিয়ে অনেক 'ট্যাবু' আছে তাই এইটা জিজ্ঞেস করলেই খুব ঘনিষ্ঠ হওয়া যাবে, খুব 'কেয়ারিং' হওয়া যাবে। অনেকেই রিলসও বানান আজকাল, 'কেয়ারিং বয়ফ্রেন্ড' কীভাবে পিরিয়ডসপীড়িত গার্লফ্রেন্ডকে গরম জলের ব্যাগ এনে দিচ্ছেন, আরাম করে দিচ্ছেন। সর্দি হলে তো নাক ঝাড়তেই হয়, সেটাই স্বাভাবিক। সেটার রিলস বানান কি? পিরিয়ডসের কথা বললেই নারীর ঘনিষ্ঠ হওয়া যায় না। এর ফলাফল কোন জায়গায় যায় সেটাও বলি ছোট্ট করে। একটি সিনেমায় দেখছিলাম, এক মেয়ে এক অদ্ভুত সমস্যায় পড়ে আত্মহত্যা করে। সে চিঠিতে নিজের হবু স্বামী ও বাবার নামে দোষ চাপিয়ে যায়। কেন হবু স্বামীর নাম সে লিখল এই নিয়ে আক্ষেপ করতে করতে ওই বীরপুঙ্গব বলে, “ক্যায়া নেহি কিয়া থা ম্যায়নে উসকে লিয়ে। উসকি পিরিয়ডস কি প্যাডস ভি ম্যায় খরিদকে দেতা থা!" কী গর্ব না! কী দুর্দান্ত সংবেদনশীলতা না?
মেয়েদের সেকেন্ড সেক্স ভাবতে শেখা, কম বুদ্ধির ভাবতে শেখা, ‘চুড়ি পরা' দুর্বল বা অকর্মণ্য ভাবতে শেখা দেশে অ্যানিমালের মতো সিনেমা 'হিট' হবে এই নিয়ে অবাক হওয়ার তাই কিস্যু নেই। অ্যানিমাল সিনেমায় আকাশপথে যৌনতার পরে নায়িকা যখন নায়ককে জিজ্ঞেস করেন 'হাও ওয়াজ ইট'? নায়ক নানা গর্ব করে বলেন, তিনি প্লেন চালাচ্ছিলেন, ভারসাম্য রাখছিলেন, মাথায় চলছিল প্লেন কীভাবে সঠিক লাইনে রাখা যায় প্লাস তিনি যৌনতাও করছিলেন, নায়িকার কিছু করার ছিল না কারণ সে পুরুষের নীচে ছিল। তাঁর তো তেমন পরিশ্রম নেই। পুরুষের রয়েছে বিশ্বলোক, কর্মযজ্ঞ, দায়িত্বভার! স্ত্রী বা প্রেমিকার যৌনতায় কোনও ভূমিকাই নেই। কোটি কোটি পুরুষ কোটি কোটি স্ত্রী ও প্রেমিকাকে এভাবেই দেখেন। বিয়ে মানেই যৌনতার সম্মতিহীন ছাড়পত্র ভাবেন। সেই কারণেই আইনে 'ম্যারিটাল রেপ' একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে ওঠে। প্রেমের সম্পর্কেও জিজ্ঞসাই করেন না যৌনতায় কোনও সমস্যা আছে কিনা, কোনও বিশেষ চাহিদা আছে কিনা, সিনেমার পর্দায় দেখা যৌনতা বাস্তবের মানুষের সঙ্গে সম্ভব কিনা তলিয়েও ভাবেন না! আগ্রাসন ও কমনীয়তার মধ্যে কোনও মহিলাই সম্ভবত উগ্রতাকে বেছে নেবেন না। অথচ মহিলার কী পছন্দ তা জিজ্ঞাসাও করেন না অধিকাংশ পুরুষ। অধিকাংশই বিশ্বাস করেন, ‘মেরি বান্দি হ্যায়'। যা আমার, তাঁর থেকে আবার এত সম্মতি, জিজ্ঞাসা কীসের! শোনার অভ্যাস পুরুষদের বরাবরের কম।
তাছাড়া বলিউড আমাদের সাড়ে সর্বনাশ তো ঘটিয়ে দিয়েছে কবেই। 'লড়কিও কি না মে হি হাঁ হোতি হ্যায়' জাতীয় প্রবাদ বাক্যটিকে বিশ্বাস করে কত কত পুরুষ কত কাল ধরে মহিলাদের অধিগ্রহণ করে গেল। জমি আর মহিলা তো অধিগ্রহণের নিমিত্তই। সেই কবে থেকে জয়াপ্রদা নেচে নেচে বলছেন তাঁকে প্রেমিক নওলাখা, হার, ঝুমকো কিনে দিলেই তিনি সেই প্রেমিককে 'সিনে সে লাগা লুঙ্গি'! কবে থেকে আশা ভোঁসলে হুমকি দিয়েই চলেছেন রেশমি চুড়ি কিনে না দিলে বাপের বাড়ি চলে যাবেন। জ্যাকলিনও বলছেন, শপিং করা দে, রোম্যান্টিক পিকচার দিখা দে! যে পুরুষ এই দেখিয়া-শুনিয়া বড় হচ্ছেন মহিলাদের সম্বন্ধে গয়না-শাড়ির বাইরে কিছু না ভাবতে পারাই স্বাভাবিক। আধদামড়া প্রেমিকাকে আধদামড়া প্রেমিক তাই টেডিবিয়ার আর গোলাপ, কানের দুল দিয়ে মুড়ে ভাবতে থাকেন এই যে তাঁর 'বান্দি', তাঁর বিশ্ব-জগৎ সংসার, রাজনীতি, অঙ্ক, সমাজতত্ত্ব, বিপ্লব সম্পর্কে কিছু বলার থাকতেই পারে না। চিরাচরিতকাল ধরে অজস্র পুরুষ তাঁদের স্ত্রীদের বলে এসেছেন, "তুমি আর কী বুঝবে?” যারা ভাবেন, আজকাল আর তেমন দিন নেই, তাদের ওই পার্লারের বাচ্চাটির কথা আবারও মনে করিয়ে দিতে চাই। বিদ্বেষকে সে প্রথা ভাবতে ভাবতে বড় হচ্ছে।
পুরুষদের কী শেখা 'উচিত', তা বলা যায় না। অনেক কিছু শেখা তো মহিলাদেরও উচিত। তবে একজন মহিলা হিসেবে পুরুষদের থেকে সংবেদনশীলতার প্রত্যাশা ছাড়া বিশেষ কিছু কাম্য নেই। একজন মহিলাকে, অন্য লিঙ্গপরিচয়ের মানুষকে সহনাগরিক ও সহযোদ্ধা ভাবতে পারলেই সমস্যার অনেকখানি সমাধান হয়ে যায়। এই যে রাজনৈতিক নেতারা, এমনকী নেত্রীরাও বলেন, “মা-বোনদের সম্মান চাই, নিরাপত্তা চাই," তারাও আসলে মা আর বোন সম্পর্কের বাইরে ভাবতে অপারগ! মা বললেই কাউকে সম্মান করা যে যায় না তা আবারও মনে করিয়ে দিই ওই পার্লার পুত্রের কথা দিয়েই। মায়ের চুলও সে ঝাঁট দিয়ে ফেলতে চায়নি, সম্মান তো দূর অস্ত! বোনদের যে কতখানি 'ইজ্জত' তা তো জনপ্রিয় গালাগালিতেই প্রমাণিত। দুর্গাকে পুজো করতেই ভালো লাগে, বাস্তব জীবনে কোনও মহিলাকে 'বস' হিসেবে ভাবতেও পুরুষদের সমস্যাই হয়। একজন নেত্রীর দুর্নীতি, অসততা নিয়ে প্রতিবাদ না করে, সরাসরি আক্রমণ না করে 'সঠিক সময়ে বিয়ে হলে রাজ্যটা বেঁচে যেত' জাতীয় 'জোকস' বানান পুরুষরাই! একজন মহিলা কারও মা-বোন- পিসিমা-মাসিমা-জেঠিমা-বৌদি বাদ দিয়েও একজন মানুষ। একজন মানুষকে সম্মান করলেই সাম্যের পথে হাঁটা হয়। লিঙ্গসাম্যের পক্ষে থিয়েটার করতে গিয়ে বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয়েছে। কোনও কোনও পুরুষ বলেছেন, এই থিয়েটার আমাদের কেন দেখাচ্ছেন, “আমরা তো আর বাড়ি গিয়ে বউ পেটাই না"! বউ না পেটানোকেই যারা নারীসুরক্ষা ও সম্মান ভাবেন তাঁদের জন্য এই লেখা নয়। এই লেখা তাঁদের জন্য তো নয়ই যারা ভিড় ট্রেনে-বাসে-অটোতে কনুই, লিঙ্গ বা আঙুল এগিয়ে দিয়ে ছুঁতে চান। ছাগল দিয়ে যেমন কিছুতেই লাঙল টানানো সম্ভব নয়, মলমূত্র দিয়ে মেকআপ সম্ভব নয়, তেমনই এদের থেকে সংবেদনশীলতা প্রত্যাশা করাটাও সম্ভব নয়। এই লেখা তাঁদের জন্যই যারা এখনও পশ্চাৎদেশ দিয়ে ভাবার কাজটা করেন না। যারা এখনও 'ছেলেরা কাঁদে না'-তে বিশ্বাসী নন। যারা এখনও ক্রমাগত নিজেকে ভাঙতে গড়তে চান, নিজেকে সুস্থ সুন্দর রাখতে চান আর ক্রমাগত প্রশ্ন করতে চান যে, নারী ও পুরুষের বা অন্য লিঙ্গের এমন সুন্দর বৈচিত্র্য, এত বিপুল রঙ, এত শাখা-প্রশাখা, এই বৈচিত্র্যের তো বৈষম্য হওয়ার কথা ছিল না। কীভাবে আমরা বিদ্বেষ পুষলাম একে অন্যের বিরুদ্ধে?
আরও পড়ুন- ওহে শান্ত লক্ষ্মীটি! এবার ওঠো, লড়ো, স্বপ্ন দেখো…
আসলে যত বিভেদ ততই তো রাষ্ট্রের সুবিধা। যত একপক্ষ অত্যাচারিত, ততই অন্যপক্ষের সুবিধা। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে নিজেদের ক্রমেই নিজেরা অপমান করে চলেছি, অসুস্থ করে চলেছি। পিতৃতন্ত্র আসলে তো একটা মরা লেজ! পুরুষ মহিলা নির্বিশেষে তা বয়ে নিয়ে চলেছি। মহিলারা বরাবর বাধ্য ছিলেন বেশি। তাই প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে এই করতে নেই, ওই করতে নেই বাণীগুলি তারাই বেশি বিশ্বাস করেছেন, মনে রেখেছেন, নতুন প্রজন্মকে দান করতে চেয়েছেন। আশ্চর্যের বিষয়, নোংরামিকে 'প্রথা' বলে চালানোর লোক ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে, এই এত যুগ পার করে এসেও। প্রশ্ন করতে তো আমরা কবেই ভুলেছি। বিবেককে প্রশ্ন করতে কবেই ভুলে গেছি, কবেই ভুলে গেছি পৃথিবীটা সমষ্টির, কেবল আমি-তুমির না। যুক্তিকে ভুলিয়ে দেওয়ার কাজ বাজার করেই চলেছে, তাতে তাদেরই লাভ। আর আমরা, ব্যা ব্যা ব্ল্যাকশিপের দল মাথা হাঁড়িকাঠে দিয়ে ভাবছি আমার পৃথিবীটা সুন্দর। আমি তো নিরাপদ, আমি তো বউ পেটাই না বা আমি তো আধুনিক ওয়ার্কিং ওম্যান!
ভাগ্যিস সমস্ত পুরুষ এমন নন। ভাগ্যিস সমস্ত মহিলাও এমন নন। আমার চারপাশে খানকতক এমন পুরুষও আছেন, যারা আগে মানুষ। এমন মহিলাও আছেন, যারা আগে মানুষ। তাঁদের কমরেড ভাবতে গর্বই হয়। ভালো লাগে, তারা নিজেদের আচরণকে প্রশ্ন করেন। তারা প্রথার মধ্যে যুক্তি খোঁজেন আজও। তারা কোনও দিন বলেন না, আমি আমার বউকে সব স্বাধীনতা 'দিয়েছি'। তারা জানেন স্বাধীনতা তাদের সম্পত্তি নয় যে কাউকে তা 'দান করবেন'। তারা জানেন, মেয়েদের 'না' এর মতো পুরুষটির 'হ্যাঁ' বা 'না'-ও সমান গুরুত্বপূর্ণ।
আসলে সতর্ক না হলে এবার সমূহ বিপদ। শ্রদ্ধা তো গোমূত্র নয়, জোর করে পান করিয়ে দিলেই কাজ হাসিল হয় না। শ্রদ্ধা ও অধিকার দুই-ই অর্জন করতে হয়। মহিলাকে নিজের বাঁ পাশে নিয়ে হেঁটে, ডিনার টেবিলে বসে চেয়ার এগিয়ে দিয়ে, ভারী ব্যাগ বয়ে দিয়ে যে পুরুষরা ভাবেন সংবেদনশীল হওয়া গেল, আর যে মহিলারা ভাবেন পুরুষের তো ঠিক এই আচরণগুলিই মহিলাদের প্রতি করণীয় তাঁদের ভাবনার গোড়াতেই গলদ। পারস্পরিক শ্রদ্ধা নেই তাতে, মোহ আছে, আছে কিছুটা দায়। আর যে সকল পুরুষ কেবল 'ইমপ্রেস' করার নিমিত্ত লিবারাল সাজেন, নিজেদের দয়ার সাগর সাজান, মহিলাটিকে দেখিয়ে 'দান-ধ্যান' করেন, ফেসবুকে বিপ্লবী সেজে সাম্যবাদ নিয়ে কথা বলেন আর প্রেমিকার দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হলে বন্ধুমহলে 'দেখিয়ে দেব' বলেন, নারী অধিকার সংক্রান্ত ভাষণ দিয়ে বাড়ি গিয়ে কোনও দিনই নিজের চা-টা অবধি নিজে বানিয়ে খান না তাঁদের আর কী বলব! আপনাদের বোধ দুই পায়ের মাঝখানে না ঝুলে বুকে ও মগজে ঠাঁই পাক! সমাজতন্ত্রের কাছে এই প্রার্থনাই করি।