কিছু পড়তে গেলেই অস্বস্তি? চুপিসারে স্থায়ী অন্ধত্ব নেমে আসছে না তো জীবনে, কীভাবে বাঁচবেন?

Diabetic retinopathy: এইমস ন্যাশনাল ব্লাইন্ডনেস অ্যান্ড ভিস্যুয়াল ইম্পেয়ারমেন্ট সার্ভে ইন্ডিয়ার রিপোর্ট বলছে, ২০১৫ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে আমাদের দেশের পঞ্চাশোর্ধ মানুষদের ১.৯৯% মানুষ অন্ধত্বের সমস্যায় ভুগেছেন।

বিশ্বজুড়ে নিঃশব্দ ঘাতকের মতো প্রভাব বিস্তার করেছে ডায়াবেটিস। শরীরে একাধিক সমস্যার সূত্রপাত ঘটাচ্ছে ডায়াবেটিস। চোখ, হার্ট ও কিডনির উপর সবথেকে বেশি প্রভাব পড়ে এই রোগের কারণে। তাই প্রথম থেকেই রক্তে সুগারের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন, নাহলে পরবর্তীকালে শরীরে বাসা বাঁধবে একাধিক জটিলতা। এর মধ্যে অন্যতম, দৃষ্টিশক্তি ক্রমশ হারিয়ে ফেলা। টাইপ-১ এবং টাইপ-২ দুই ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রেই এই সমস্যা লক্ষ্য করা যায়। অনেকেরই জানা যে, ডায়াবেটিসের কারণে রোগীর দৃষ্টি ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে আসছে, কিন্তু এর কারণ কী? চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় এই রোগকে ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি বলে। এইমস ন্যাশনাল ব্লাইন্ডনেস অ্যান্ড ভিস্যুয়াল ইম্পেয়ারমেন্ট সার্ভে ইন্ডিয়ার রিপোর্ট বলছে, ২০১৫ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে আমাদের দেশের পঞ্চাশোর্ধ মানুষদের ১.৯৯% মানুষ অন্ধত্বের সমস্যায় ভুগেছেন। আর এই অন্ধত্বের অন্যতম কারণ হল ডায়াবেটিস।

ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি কাকে বলে?

দীর্ঘদিন ধরে অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস রোগীদের ক্ষেত্রে চোখের সমস্যা দেখা দেয়। অতিরিক্ত শর্করার উপস্থিতির কারণে রেটিনার রক্ত সরবরাহকারী নালিতে রক্তপ্রবাহে বাধা সৃষ্টি হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, রেটিনা হল চোখের সবচেয়ে সংবেদশীল অংশ। চোখের পিছনে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ স্নায়ুর সঙ্গে যোগ রয়েছে রেটিনার। বস্তু থেকে আলোকরশ্মি চোখে এসে পড়লে রেটিনায় তার প্রতিবিম্ব তৈরি হয়। ফলে আমাদের চারপাশের দৃশ্য দৃষ্টিগোচর হয়। অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসের কারণে রেটিনায় রক্তপ্রবাহ হ্রাস পেলেও অক্সিজেনের অভাবে প্রদাহ তৈরি হয়ে রক্তনালীগুলি বন্ধ হয়ে যায়। এমনকী ভিট্টিয়াসে রক্তপাত হয় এবং পরবর্তী সময় রেটিনা আলাদা হয়ে সরে আসে। এর ফলে দৃষ্টিশক্তি হ্রাস থেকে শুরু করে স্থায়ী অন্ধত্ব পর্যন্ত দেখা দিতে পারে।

আরও পড়ুন- ঘরে ঘরে শিশুদের শরীরেও হানা দিচ্ছে এই ঘাতক ডায়াবেটিস! কীভাবে লক্ষণ চিনবেন

উপসর্গ

একাধিক গবেষণা থেকে জানা গিয়েছে, ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি নীরব ঘাতকের মতো চুপিসারে প্রভাব বিস্তার করে। প্রথমদিকে এই রোগের কোনও উপসর্গ নাও থাকতে পারে। আর তাই ডায়াবেটিস আক্রান্তদের নির্দিষ্ট সময় অন্তর চিকিৎসকরা চোখ পরীক্ষা করিয়ে নেওয়ার পরামর্শ দেন। তবে ঝাপসা দৃষ্টি, কিছু পড়তে গেলে অস্বস্তি, দূরের জিনিস দেখতে অসুবিধার মতোই সাধারণ উপসর্গ দেখা যায় এই রোগে। চোখে ব্যাথাও অনুভব হতে পারে কিছু ক্ষেত্রে। রেটিনা সরে আসার কারণে দৃশ্য বস্তুর বেশ কিছু অংশ কালো দেখায়। আচমকা দৃষ্টি লোপ পেতে পারে কোনও কোনও রোগীর ক্ষেত্রে।

কোন ধরনের ডায়াবেটিসে এই সমস্যা বেশি দেখা যায়?

টাইপ ১ এবং টাইপ ২ দু’ধরনের ডায়াবেটিস রোগীদের ক্ষেত্রেই ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি দেখা দিতে পারে। তবে টাইপ-২ ডায়াবেটিসে এই সমস্যা তুলনামূলক পরে আসে। এক্ষেত্রে টাইপ-১ ডায়াবেটিস জিনগত রোগ। এই সমস্যা অনেক কম বয়স থেকেই জাঁকিয়ে বসে রোগীর শরীরে। ফলে টাইপ-১ ডায়াবেটিস রোগীদের ক্ষেত্রে এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বহুগুণ বেশি। এছাড়াও যাঁরা ৩০ বছরের আগে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত তাঁদের ৫০ শতাংশই ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথিতে আক্রান্ত হন।

ধরন

১. সিম্পল ব্যাকগ্রাউন্ড ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি: বয়স্ক ডায়াবেটিস রোগীদের ৩০ শতাংশের মধ্যেই এই ধরনের ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি লক্ষ্য করা যায়।

২. ব্যাকগ্রাউন্ড ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি ও ম্যাকুলার ইডিমা: এতে অনেকের রেটিনোপ্যাথির মাত্রা কম হলেও ম্যাকুলা অংশে জল জমে দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হয়ে আসে।

৩. নন প্রলিফারেটেড ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি: ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীদের অন্ধত্বের মূল কারণ নন-প্রলিফারেটেড ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি। রেটিনোপ্যাথির একাধিক সমস্যার পাশাপাশি নতুন রক্তনালী তৈরি হলো এই ধরনের রেটিনোপ্যাথির প্রধান বৈশিষ্ট্য। ইনসুলিন নির্ভর রোগীদের ক্ষেত্রে এর ঝুঁকি অনেক বেশি।

রোগ নির্ণয়

একাধিক পরীক্ষার মাধ্যমে ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি নির্ণয় করা হয়-

১. ফ্লুরোসিন অ্যাঞ্জিওগ্রাফি: রেটিনার রক্তনালীতে রক্ত প্রবাহ ঠিক আছে কিনা তা জানার জন্য এই পরীক্ষা করা হয়। সাধারণ ভাষায় এই পরীক্ষাকে চোখের এক্স-রে বলে। রেটিনা ছাড়া চোখের স্তরের রক্ত সঞ্চালন দেখতে এই পরীক্ষা করা হয়।

২. কালার ফান্ডাস ফটোগ্রাফি: আধুনিক ফান্ডাস্ট ক্যামেরার মাধ্যমে রেটিনার ছবি তোলা হয়। রেটিনার ছবি ডকুমেন্ট রেকর্ড রাখার গুরুত্বপূর্ণ উপায় এবং রোগ চিকিৎসার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক।

৩. স্লিটল্যাম্প পরীক্ষা: এই পরীক্ষার মাধ্যমে দুটো চোখের রেটিনার গঠন ও তার ক্ষতের পরিমাপ করা হয়। ফলে রেটিনার খুব সূক্ষ্ম ক্ষত সহজেই এই পরীক্ষার মাধ্যমে ধরা পড়ে।

আরও পড়ুন- বিপদের নাম ‘লেজি আই’, সন্তানের দৃষ্টিশক্তি বাঁচাতে কী করবেন

চিকিৎসা

প্রথম দিকে রোগ শনাক্ত করা সম্ভব হয় না এক্ষেত্রে। তবে যদি প্রাথমিক পর্যায়ে এই রোগ নির্ণয় করা যায় তবে কোলেস্টরল, ডায়াবেটিস,রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করা হয়। যদিও এই রোগ সম্পূর্ণভাবে নিরাময় করা সম্ভব নাহলেও চিকিৎসার মাধ্যমে কর্মক্ষম দৃষ্টিশক্তি দীর্ঘদিন পর্যন্ত ধরে রাখা যায়। সাধারণত চোখের ভেতর স্টেরয়েড জাতীয় ইনজেকশন প্রয়োগ, লেজার রশ্মি এবং ভিট্রেকটমি অপারেশনের মাধ্যমে এই রোগের চিকিৎসা করা হয়।

প্রতিরোধের উপায়

১. যথাযথভাবে ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ এবং স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপন।

২. রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে আনা।

৩. ডায়বেটিস আক্রান্ত রোগীদের বছরে অন্তত একবার চক্ষু পরীক্ষা করানো জরুরি।

৪. ওজন বেশি হলে তা কমানোর চেষ্টা করতে হবে। প্রয়োজনে পুষ্টিবিদের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে।

৫. ধূমপান বর্জন করা প্রয়োজন।

৬. ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির প্রাথমিক লক্ষণ দেখা দিলেও ফেলে না রেখে চিকিৎসা করানো জরুরি।

More Articles