নয়া সংসদ ভবনে নরেন্দ্র মোদির 'অভিষেক'! কোথা থেকে এল এই রাজদণ্ড?

New Parliament Inauguration: সেঙ্গোল শব্দটি এসেছে তামিল শব্দ 'সেম্মাই' থেকে। সেম্মাই মানে 'ধার্মিকতা'।

দেশে প্রজারাই সব। প্রজাদের তন্ত্র দেশকে চালায়। অন্তত সংবিধানে তেমনই বলা কওয়া আছে। ৭৫ বছর হয়ে গেছে দেশের স্বাধীনতার। দেশে পুরোনো সংসদ ভবনের পাশে কোটি কোটি টাকা খরচা করে নয়া চোখ ধাঁধানো সংসদভবন গড়া হয়েছে। ২৮ মে সেই নতুন সংসদ ভবনের উদ্বোধনে ভারতবর্ষ যে চিত্র দেখেছে তাতে প্রজাতন্ত্র শব্দটি নিয়ে কিঞ্চিৎ প্রশ্ন উঠছে বৈকি! নয়া সংসদ ভবনে 'রাজদণ্ড' স্থাপন করেছেন নরেন্দ্র মোদি। দেশের সাধুরা নরেন্দ্র মোদির হাতে এক রাজদণ্ড তুলে দিয়েছেন। ঠিক যেন কোনও রাজার অভিষেক হলো নয়া সাম্রাজ্যে। ধর্মনিরপেক্ষ দেশের সংসদ ভবনের উদবোধনে কেনই বা হিন্দু সাধুদের রমরমা, কেনই বা রাজদণ্ড স্থাপন, কেনই বা হিন্দু আচার অনুষ্ঠানের এমন ব্যাপক আয়োজন, প্রশ্ন উঠছে। হঠাৎ এই রাজদণ্ড স্থাপনের বিষয়টি সংসদে এসে জুটলই বা কীভাবে? সত্যিই কি দেশে তবে রাজতন্ত্রের ধারণা শুরু হচ্ছে নতুন করে?

এই যে রাজদণ্ডটি, তা নতুন সংসদ ভবনে স্পিকারের চেয়ারের কাছে স্থাপন করা হবে। কিন্তু কেন? "জাদুঘর থেকে 'সেঙ্গল' এনে আনুষ্ঠানিকভাবে মোদির কাছে হস্তান্তর করা তাঁর 'অভিষেকের' প্রতীক। নতুন সংসদ ভবনে এটিকে বিশেষভাবে প্রদর্শন করা, নাগরিক গণতন্ত্রকে নষ্ট করে 'রাজা ও প্রজা'-র শাসন ফিরিয়ে আনারই প্রতীক,” বলেছেন সিপিআই(এম) নেতা সীতারাম ইয়েচুরি। বামেদের বিতর্ক একদিকে, তারই অন্যপাশে কংগ্রেস আর বিজেপির বিতর্ক শুরু হয়েছে একদম গোড়া থেকে। বলা হচ্ছে, এই রাজদণ্ড নতুন কোনও বিষয় নয়। কংগ্রেসের প্রধানমন্ত্রীর হাতেই প্রথম নাকি এই রাজদণ্ড তুলে দেওয়া হয়েছিল!

আরও পড়ুন- কেন স্বাধীনতার ৭৫ বছর পর দরকার পড়ল নতুন সংসদ ভবনের?

এখানেই শেষ নয়, বলা হচ্ছে, ব্রিটিশদের থেকে ভারতে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রতীক এই দণ্ড। লর্ড মাউন্টব্যাটেন, সি রাজাগোপালাচারী এবং প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু নাকি এই রাজদণ্ডকে ব্রিটিশদের দ্বারা ভারতে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রতীক হিসাবেই বর্ণনা করেছেন। যদিও, কংগ্রেস নেতা জয়রাম রমেশ বলছেন, এই বিষয়ে কোনও নথিভুক্ত প্রমাণ কোত্থাও নেই। আম্বালাভানা দেশিকা পরমাচার্য স্বামী থিরুভাবাদুথুরাই আদিনাম বলেছেন, এটিই সেই রাজদণ্ড যা ১৯৪৭ সালে ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুকে দেওয়া হয়েছিল এবং এটি তামিলনাড়ুর গর্ব।

তামিলনাড়ু থেকে ৩০ জন আদিনাম সাধু দিল্লিতে এসে পৌঁছন। শৈব মঠ থিরুভাবাদুথুরাই আদিনামের সন্ন্যাসীরা শনিবার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাসভবনে এই রাজদণ্ড হস্তান্তর করেন। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণও সেই মুহূর্তে প্রধানমন্ত্রীর বাড়িতে উপস্থিত ছিলেন। নতুন সংসদে লোকসভার স্পিকারের আসনের পাশে এটি বসানো হবে।

প্রাচীনকাল থেকেই রাজদণ্ড হিসাবে পরিচিত এই সেঙ্গোল। এই রাজদণ্ড ক্ষমতার প্রতীক, প্রজাদের জন্য রাজার প্রতিশ্রুতিরও প্রতীক। এই রাজদণ্ড চোল রাজাদের শাসনের সঙ্গেও যুক্ত। প্রাক্তন রাজারা ক্ষমতার উত্তরাধিকার হস্তান্তর করার সময় সেঙ্গোলটিকে নবনির্বাচিত রাজার হাতে তুলে দিতেন। রামায়ণ-মহাভারতেও এ ধরনের উত্তরাধিকার হস্তান্তরের উল্লেখ আছে। মহাভারতে যুধিষ্ঠিরের রাজ্যাভিষেকের সময়ও রাজদণ্ডের উল্লেখ আছে। শান্তিপর্বে রাজদণ্ড প্রসঙ্গেই বলা হয়েছিল, এই রাজদণ্ডই রাজার ধর্ম, এই দণ্ডই ধর্ম ও অর্থ রক্ষা করে। রাজ্যাভিষেকের পদ্ধতি অনুযায়ী, রাজা যখন সিংহাসনে বসেন, তিনি তিনবার 'আদণ্ডৌ অস্মি' বলেন। রাজপুরোহিত তাঁকে পলাশের লাঠি দিয়ে আলতো আঘাত করে বলেন 'ধর্মদণ্ড্যোঃ অসি' বলে। রাজার কথার অর্থ হলো, তাঁকে শাস্তি দেওয়া যাবে না। পুরোহিতের কথার অর্থ হচ্ছে, ধর্ম রাজাকেও শাস্তি দিতে পারে। এই বলেই রাজার হাতে রাজদণ্ড তুলে দেওয়া হয়।।

আরও পড়ুন- দূরদর্শনে মোদির স্তুতিতে তথ্যচিত্র! ঐতিহ্যের নামে বাদ পড়ল ভারতে প্রকৃত ইতিহাসই?

সেঙ্গোল শব্দটি এসেছে তামিল শব্দ 'সেম্মাই' থেকে। সেম্মাই মানে 'ধার্মিকতা'। এই রাজদণ্ডই রাজাকে ন্যায্য শাস্তি দেওয়ার অধিকারী করে তোলে। রাজদণ্ড ব্যবহৃত হয়েছে মৌর্য সাম্রাজ্যে, চোল সাম্রাজ্যে, গুপ্ত সাম্রাজ্য এবং বিজয়নগর সাম্রাজ্যেও। সম্প্রতি ব্রিটেনে প্রিন্স চার্লসের রাজ্যাভিষেকের সময়ও রাজদণ্ডের প্রতীক একটি লাঠি তাঁর হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে।

মোদির হাতে যে রাজদণ্ড তুলে দেওয়া হয়েছে তাতে চূড়ায় রয়েছে নন্দীর মূর্তি। নন্দীর মূর্তি শৈব ঐতিহ্যের সঙ্গে যুক্ত। পাশাপাশি নন্দী আত্মসমর্পণের প্রতীক। নন্দী যে বৃত্তাকার মঞ্চে প্রতিষ্ঠিত তা নাকি বিশ্বের প্রতীক। রাজদণ্ডের দৈর্ঘ্য পাঁচ ফুট। এতে লক্ষ্মীর ছবিও খোদাই করা রয়েছে।

More Articles