"জয় অথবা মৃত্যু"! বিশ্বকাপ ফাইনালের আগে ফুটবলারদের টেলিগ্রাম করলেন মুসোলিনি

World Cup Football 1938: মেয়াৎজ়া ধীর গতিতে সামান্য কয়েক পা দৌড়ে এল, ঠিক যখন সে শটটা নেবে, তখন সে নিজের হাফ প্যান্টটা খুলে ফেলল।

এরিকো

চাকো-র যুদ্ধে বলিভিয়া আর প্যারাগুয়ের চাষিরা যখন চাষবাস ছেড়ে গণহত্যার তাণ্ডবলীলায় মেতেছে, তখন প্যারাগুয়ের বহু ফুটবলার অন্য দেশে গিয়ে খানিক অর্থের সংস্থান করার চেষ্টা চালাচ্ছিল। যে মরুভূমিতে কখনও কোনও পাখি শিস দিয়ে ওঠেনি, কোনও মনুষ্যশাবকের পদচিহ্ন পড়েনি, সেই ভূখণ্ড কব্জায় রাখার জন্য লড়াই করতে গিয়ে যারা শেষ পর্যন্ত আহত, ক্ষত বিক্ষত হয়েছিল তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করাই সেই সব ফুটবলারদের লক্ষ্য ছিল। এই সূত্রেই আর্সেনিও এরিকোর বুয়েনস আইরেসে আসা। কিন্তু সে ওখানেই চিরকালের মতো থেকে যায়। আরহেন্তিনার ঘরোয়া ফুটবলে সব থেকে বেশি গোল করেছে জন্মসূত্রে প্যারাগুয়ের ফুটবলার এরিকো। এক এক মরসুমে তার গোলের সংখ্যা চল্লিশের উপর।

ওর শরীরে যেন গোপন স্প্রিং লাগানো ছিল। ও যেন ইন্দ্রজাল রপ্ত করেছিল, একটুও হাঁটু ভাঁজ না করে লাফিয়ে উঠতে পারত, আর সব সময় এমনই লাফাত যে গোলকিপারের ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যেত। ওর পা দুটো দেখে যতটা ঢিলেঢালা শিথিল মনে হতো, তেমনই তীব্র ঝাপটায় এরিকোর শট আছড়ে পড়ত জালে। বলকে কখনও কখনও সে গোড়ালি দিয়েও চাবকে সিধে করত। ফুটবলের এতকালের ইতিহাসে ওর মতো বিষাক্ত ব্যাকহিল মারার ক্ষমতা নিয়ে আর কেউ আসেনি।

এরিকো যেদিন গোল করত না সেদিন সহ খেলোয়াড়দের জন্য চমৎকার সব পাস সাজিয়ে দিত, যা থেকে গোল না করাটাই অস্বাভাবিক। আরহেন্তিনার কবি কাতুলো কাস্তিয়ো এরিকোকে একটি ট্যাঙ্গো উৎসর্গ করেছিলেন:

তোমার গোড়ালির বিষাক্ত ছোঁয়া কিংবা লাফিয়ে উঠে
যেভাবে মাথা ছোঁয়াও বলে,
এমন ছবি আর কি কখনও কবে
হাজার বছরেও দেখা যাবে !

সত্যিই এরিকো নৃত্যশিল্পীর সুষমায় ফুটবল খেলত। বিখ্যাত ফরাসি লেখক পল মোহঁ এরিকোর খেলা দেখে মন্তব্য করেছিলেন, "পায়ে বল নিয়ে লোকটা তো নিজিনস্কির ব্যালে দেখার স্মৃতি জাগিয়ে তোলে!"

আরও পড়ুন- উড়ন্ত গোল করতে করতেই মারাত্মক সংঘর্ষ, বাইসাইকেল কিক কেড়েছিল ফুটবলারের প্রাণ

১৯৩৮-এর বিশ্বকাপ

ম্যাক্স থাইলার তখন হলুদ জ্বরের টিকা আবিষ্কারে ব্যস্ত, ফটোগ্রাফি আর শুধু সাদাকালো না থেকে রঙিন হয়ে উঠছে, ওয়াল্ট ডিজ়নির ‘স্নো হোয়াইট’ মুক্তি পেয়েছে এবং আইজেনস্টাইন ‘আলেকজ়ান্ডার নেভস্কি’ বানাচ্ছেন। তখনও হার্ভার্ডের জনৈক অধ্যাপকের নাইলন আবিষ্কার খুব পুরনো ঘটনা হয়ে যায়নি এবং ওই নাইলন ব্যবহার করা শুরু হয়েছে প্যারাসুটে আর মেয়েদের পা-ঢাকা বাহারি মোজায়।

দুই আরহেন্তিনীয় কবি আলফোনসিনা স্তোরনি আর লিয়োপোলদো লুগোনে আত্মহত্যা করবেন। লাসারো কারদেনাস মেহিকোয় তেলের খনিগুলোর জাতীয়করণ করে নানারকম অবরোধ আর পশ্চিমি ঝঞ্ঝার মুখোমুখি। এইচ জি ওয়েলসের ‘ওয়ার অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ অবলম্বনে রেডিও নাটক বানিয়ে অরসন ওয়েলস আমেরিকার কানপাতলা লোকেদের এমন একটা সময়ে মঙ্গলগ্রহের প্রাণীর হাতে আক্রান্ত পৃথিবীর গল্প শুনিয়ে ভয় দেখাচ্ছেন, যখন স্ট্যান্ডার্ড অয়েল পুরোদস্তুর মেহিকো আক্রমণের দাবি তুলছে। তারা কারদেনাসের কালাপাহাড়ি আচরণ বন্ধ করে খনি জাতীয়করণের মতো বাজে উদাহরণ দুনিয়া থেকে মুছে দিতে খুবই ব্যগ্র হয়ে উঠেছিল।

ইতালিতে জাতীয়তা বিষয়ক ম্যানিফেস্টো রচিত হচ্ছে আর ইহুদিদের উপর আক্রমণের ঘটনা ক্রমশ বাড়ছে। জার্মানি অস্ট্রিয়া দখল করছে; হিটলার ইহুদি শিকারে উন্মত্ত হয়ে উঠেছে আর প্রবল আক্রোশে একের পর এক ভূখণ্ড দখল করার মতলব আঁটছে। ইংল্যান্ডের সরকার তখন একদিকে দেশের জনসাধারণকে খাবারদাবার জমিয়ে রাখার পরামর্শ দিচ্ছে, অন্যদিকে বিষাক্ত গ্যাসের আক্রমণ থেকে বাঁচার কায়দা-কৌশল শেখাচ্ছে। জেনারেল ফ্রাঙ্কো গণপ্রজাতন্ত্রে প্রতিরোধের শেষ দেওয়ালটাও ভেঙে ফেলে ভ্যাটিকানের অনুমোদন আনিয়ে নিয়েছে। পেরুর কবি সেসার ভাইয়েহো যক্ষ্মা রোগাক্রান্ত অবস্থায় পারি শহরে দারিদ্র্যে, উপবাসে তিল তিল করে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন তখনই, সম্ভবত ভরা বর্ষায়, জ়ঁ-পল সার্ত্র প্রকাশ করছেন বিবমিষা। ঠিক সেই সময়, পারিতেই, সম্ভাব্য যুদ্ধের প্রলম্বিত করাল ছায়ায়, শহরের দেওয়ালে দেওয়ালে যখন পিকাসোর ‘গ্যের্নিকা’ কলঙ্কিত সময়টাকে চিনিয়ে দিচ্ছে, তৃতীয়বারের বিশ্বকাপের আসর বসল। কুলুম্ব স্টেডিয়ামে ফরাসি রাষ্ট্রপতি আলব্যের লেব্রঁ বলে লাথি মেরে আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্বকাপের উদ্বোধন করতে গিয়ে অনভ্যাসে বলের বদলে মাটিতেই পা ঠুকে কাজ সারল।

আগের বিশ্বকাপের মতোই, এবারেরটাও ছিল মূলত ইওরোপের দলগুলোর বিশ্বকাপ। ইওরোপের এগারোটা দলের পাশে দক্ষিণ আমেরিকার দুটো মাত্র দল খেলেছিল সেবার। তবে সুদূর ইন্দোনেশিয়া থেকে, তখনও লোকে তাকে ডাচ ইস্ট ইন্ডিজ বলেই ডাকত, একটা দল এসেছিল। পারিতে তারাই ছিল আমাদের গ্রহের বাকি অংশের একমাত্র প্রতিনিধি।

সদ্য দখল করা অস্ট্রিয়ার পাঁচজন খেলোয়াড়কে জার্মানি তাদের দলে নিয়েছিল। তার উপরে বুকে স্বস্তিক চিহ্ন সেঁটে, হাতে হাবিজাবি নাৎসি চিহ্ন-প্রতীক লাগিয়ে জার্মান একাদশ সেবার বিপুল শক্তি সঞ্চয় করে এসেছিল। তারা নিজেদের যখন দুর্ভেদ্য বলতে শুরু করেছে ঠিক তখনই সুইজ়ারল্যান্ডের কাছে হোঁচট খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে। জার্মান ফুটবল দলের এভাবে বেকুব হওয়ার কয়েকদিনের মধ্যেই নিউ ইয়র্কে ফের একবার আর্য আধিপত্যের ধারণা চুরমার হয়ে গেল, যখন কৃষ্ণাঙ্গ মুষ্টিযোদ্ধা জো লুই জার্মানির ম্যাক্স শ্মেলিংকে রিংয়ের মধ্যে উলটে দিল।

এদিকে ইতালি কিন্তু আগেরবারের মতোই খেলতে লাগল। সেমিফাইনালে, ইতালির ফুটবলপ্রেমী মানুষের আদরের নীল জার্সির দল আৎজ়ুরি ব্রাজ়িলকে হারায়। সেদিন একটা পেনাল্টি নিয়ে প্রশ্ন না উঠলেই বরং অস্বাভাবিক হত। কিন্তু ব্রাজ়িলের কোনও প্রতিবাদই রেফারি কানে তুলল না। ১৯৩৪-এর মতোই সেবারও সব রেফারিই ছিল ইওরোপের।

তারপর এল ফাইনাল; ইতালি বনাম হাঙ্গেরি। মুসোলিনির কাছে ফাইনাল জেতা তখন পররাষ্ট্র নীতির মতোই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। খেলা শুরুর খানিক আগে রোম থেকে ইতালির খেলোয়াড়দের কাছে ফ্যাসিস্ত প্রধানের সই করা তিন শব্দের একটি টেলিগ্রাম এল: "জয় অথবা মৃত্যু"। খেলোয়াড়দের অবিশ্যি মরতে হয়নি, কেননা ইতালি সেই ম্যাচটা ৪-২ গোলে জেতে। পরদিন খেলোয়াড়রা মিলিটারির পোশাক পরে পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে যায়। তাদের প্রিয় ‘ইল দুচে’ই সেই সভার সভাপতি ছিল।

লা গেজেত্তা দেল্লো স্পোর্ত উচ্ছ্বসিত হয়ে লেখে, "ফ্যাসিস্ত জমানায় খেলায় এমন মহত্ব অর্জন আমাদের জাতির শ্রেষ্ঠত্বই প্রমাণ করে"। এর কিছুদিন আগেই সেই দেশের সংবাদমাধ্যম ব্রাজ়িলকে হারানো উদযাপন করতে গিয়ে লিখেছিল, "নিগ্রোদের পাশবিক শক্তিকে রুখে দিতে ইতালির খেলোয়াড়রা যে বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছে আমরা তাকে কুর্নিশ জানাই"।

সেবার বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড়দের তালিকা তৈরি করেছিল আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিরা, সেইজন্যেই বোধহয় তালিকায় দু'জন কৃষ্ণাঙ্গের ঠাঁই হয়েছিল, ব্রাজ়িলের লেওনিদাস আর দোমিঙ্গোস দা গিয়া। লেওনিদাস আটটা গোল করে তালিকার শীর্ষে ছিল, তারপরেই সাতটা গোল করেছিল হাঙ্গেরির ঝেঙ্গেলের। লেওনিদাস নিজের সেরা গোলটি করেছিল পোল্যান্ডের বিরুদ্ধে। সেদিন প্রবল ঝড়বৃষ্টির মধ্যে খেলা চলছিল, পেনাল্টি বক্সের মধ্যে কাদায় লেওনিদাসের জুতো যায় খুলে, সে খালি পায়েই গোল করে আসে।

আরও পড়ুন- ১১ জন ফুটবলারকেই পাহাড়ের চুড়োয় দাঁড় করিয়ে গুলি করে মেরেছিল হিটলারের দল

মেয়াৎজ়ার গোল

১৯৩৮-এর বিশ্বকাপের কথাই বলছি। সেমিফাইনালে ইতালি আর ব্রাজ়িল প্রচণ্ড ঝুঁকি নিয়ে প্রাণান্তকর চেষ্টা চালাচ্ছিল, মনে হচ্ছিল বুঝি সর্বস্ব বাজি রেখে নেমেছে।

ইতালির স্ট্রাইকার পাইয়োলা হঠাৎ গুলি খেয়ে মরে যাওয়ার মতো লুটিয়ে পড়ে গেল, আর মরে যেতে যেতে অপরাধী চিনিয়ে দিতে তর্জনী তুলে ব্রাজ়িলের রক্ষণভাগের খেলোয়াড় দোমিঙ্গোস দা গিয়াকে শনাক্ত করল। স্বাভাবিকভাবেই রেফারি একটুও সময় নষ্ট না করে বাঁশি বাজিয়ে পেনাল্টি দিল। ব্রাজ়িলের খেলোয়াড়দের আপত্তি, হতাশা আকাশের নীলে মিলিয়ে গেল। একটু পরেই পাইয়োলা অম্লানবদনে প্যান্টের ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে মৃত্যুশয্যা থেকে সটান উঠে দাঁড়াল। জুসেপ্পে মেয়াৎজ়া তখন কামান দাগার জন্য প্রস্তুত হয়ে বলটাকে পেনাল্টি স্পটে বসাল।

পুরনো দিনের ছবিতে মেয়াৎজ়াকে দেখলে মনে হবে একেবারে ফুলবাবুটি। উচ্চতায় একটু খাটো, কিন্তু সুদর্শন লাতিন প্রেমিকের মতো মুখখানা। পেনাল্টি মারায় ধুরন্ধর। সেমিফাইনালের দিন পেনাল্টি মারতে এসে সে গোলকিপারের দিকে থুতনিটা সামান্য তুলে প্রায় মাতাদোরের ভঙ্গিতে তাকাল। তার পায়ের শট সে নিজের করতলের মতোই চিনত, তাই পেনাল্টিতে বলে-বলে গোল করত। কিন্তু ব্রাজ়িলের গোলি ওয়াল্তেরও পেনাল্টি ঠেকানোয় ওস্তাদ ছিল। সেমিফাইনালের দিন ওয়াল্তেরকে খুবই আত্মবিশ্বাসী দেখাচ্ছিল।

মেয়াৎজ়া ধীর গতিতে সামান্য কয়েক পা দৌড়ে এল, ঠিক যখন সে শটটা নেবে, তখন সে নিজের হাফ প্যান্টটা খুলে ফেলল। এই দেখে দর্শকরা তো হতচকিত, এমনকী রেফারিও নিজের বাঁশিটা প্রায় গিলে ফেলছিল। কিন্তু একবারও না থেমে প্যান্টটা একহাতে চেপে ধরে রেখে মেয়াৎজ়া গোল করে দিল। করবে নাই-বা-কেন? হাসতে-হাসতে গোলকিপার যে তখন বর্মহীন, গোল অরক্ষিত।

এই গোলেই ইতালি ফাইনালে ওঠার ছাড়পত্র পায়।

লেওনিদাস

তার শরীর ছিল শক্তপোক্ত, বল নিয়ে প্রবল গতিতে দৌড়ত এবং চালাকিতে সে ছিল মশার মতোই ধূর্ত। ১৯৩৮-এর বিশ্বকাপে পারি ম্যাচ কাগজের এক সাংবাদিক দেখেছিল, লেওনিদাস নাকি ছ' পায়ে দৌড়চ্ছে, আর এজন্য সাংবাদিকপ্রবর কালা জাদুকেই দায়ী করেছিলেন। সাংবাদিকটি খেয়াল করেছিলেন কিনা জানি না, লেওনিদাসের অনেকগুলো পায়ের অতিমানবিক ক্ষমতাও ছিল, তার পা গুলো হঠাৎ কয়েক গজ করে লম্বা হয়ে যেত, তারপর সেগুলো ফের ভাঁজ হয়ে জড়িয়ে-মড়িয়ে গিঁট পাকিয়েও যেত।

লেওনিদাস দা সিলভার যেদিন অভিষেক হয়, সেদিনটা ছিল চল্লিশোর্ধ আর্তুর ফ্রিদেহাইশের অবসর নেওয়ার দিন। লেওনিদাস প্রথম ম্যাচেই পূর্বতন নায়কের হাত থেকে রাজপাট সামলাতে রাজদণ্ডটি হাতে তুলে নেয়। অনতিবিলম্বেই তার নামে বাজারে সিগারেট বেরোয়, লজেঞ্চুসও পাওয়া যেতে থাকে। সে ভক্তদের কাছ থেকে যেকোনও চিত্রতারকার চেয়ে বেশি চিঠি পেত; সেসব চিঠিতে কেউ তার ছবি চেয়ে পাঠাত, কেউ অটোগ্রাফ, কেউ কেউ সরকারি চাকরি চেয়েও আবেদন করত।

লেওনিদাস প্রচুর গোল করেছে, কিন্তু সেসব সে মনে রাখত না। গোলগুলোর মধ্যে বেশ কিছু আবার হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে করা, তার পা তখন লাট্টুর মতো ঘুরত, গোলের দিকে পিঠ করে মারা শট, হেঁটমুণ্ড ঊর্ধ্বপদ। সেই বিখ্যাত ‘চিলে’ শট। ব্রাজ়িলের লোকেরা যাকে বাইসাইকেল বলে অভ্যস্ত। লেওনিদাসের গোল এতই দর্শনীয় হতো যে গোলকিপারও মাটি ছেড়ে উঠে এসে তাকে অভিনন্দন জানিয়ে যেত।

আরও পড়ুন- মুরগির মাংস খেলেই ম্যাচে হার! ফুটবলের বিচিত্র কুসংস্কারের এই ইতিহাস অজানাই

দোমিঙ্গোস

পুবদিকে চিনের পাঁচিল আর পশ্চিমদিকে আমাদের এখানে দোমিঙ্গোস দা গিয়া।

ফুটবলের ইতিবৃত্তে তার মতো জমাট রক্ষণভাগের খেলোয়াড় আর আসেনি। দোমিঙ্গোস চার চারটে শহরের চ্যাম্পিয়ান ছিল। হিউ দে জেনেইরো, সাও পাওলো, মন্তেভেদিয়ো এবং বুয়েনস আইরেস- চারটে শহরের ছেলেবুড়ো সবাই তাকে ভালোবাসত। তার খেলা থাকলে স্টেডিয়ামে একটা আসনও খালি থাকত না।

ফুল ব্যাকে যারা খেলে তারা সাধারণত বিপক্ষের স্ট্রাইকারের গায়ে ডাকটিকিটের মতো সেঁটে থাকে, স্ট্রাইকারের পায়ে বল এলেই যত দ্রুত সম্ভব খোসা ছাড়ানোর মতো তার পা থেকে বল ছাড়িয়ে নেয়। শুধু তাই-ই নয়, নিজের পায়ে বলা রাখারও জ্বালা আছে, সেজন্য মলয় বাতাসে ভাসিয়ে বলটাকে নীল দিগন্তের কাছাকছি পাঠিয়ে দেয়। দোমিঙ্গোস বিপক্ষের খেলোয়াড়দের পা থেকে বল চুরি করার সময় তার পা পিষে চলে যেতে দিত; তারপরও তার হাতে অফুরন্ত সময় থাকত বলটাকে নিরাপদে বক্সের বাইরে নিয়ে যাওয়ার। চির প্রশান্ত এক ব্যক্তিত্ব, মৃদু শিস দিতে দিতে অন্যদিকে তাকাত। গতিকে সে ঘৃণা করত। আজকের ভাষায়, সে যেন স্লো মোশনে ফুটবল খেলত। শ্বাসরোধী উৎকণ্ঠা তৈরির রাজা, অবসরের উপাসক; বক্সের ভেতর থেকে নিখুঁতভাবে বল বাইরে নিয়ে যাওয়ার শিল্প তাই লোকমুখে নাম পেয়েছে দোমিঙ্গাদা। দোমিঙ্গোস যখন কোনও বল ধরে রাখতে না পারায় স্ট্রাইকার তাকে টপকে এগিয়ে যেত, সে কিন্তু কক্ষনও বলের পিছু ধাওয়া করত না। বলের পিছনে দৌড়নো তার স্বভাববিরুদ্ধ ছিল। নারীর মতোই বল তাকে ছেড়ে গেলে সে বিষণ্ণ হয়ে পড়ত।

বল কিংবা প্রেমিকা স্মরণে

এই যে বলটা দেখছেন, ও সারাজীবন আমার পাশে থেকেছে। ও কিংবা ওর বোন, বুঝতে পারছেন তো ? ওদের পরিবারের কাছেই আমি কৃতজ্ঞ, ঋণী। পৃথিবীতে ওই ছিল আমার চাবিকাঠি খুল যা সিমসিম। তাকে ছাড়া খেলা তো অসম্ভব, তাই না ? আমি শুরু করেছিলাম বাঙ্গু-র কারখানায়। দিনের পর দিন খাটতে খাটতে জিভ বেরিয়ে যেত। ওখানেই আমার তার সঙ্গে দেখা হয়। তাকে পেয়ে আমার জীবনে বসন্ত বাতাস বয়ে যায়।

আমি তো কম দেশ ঘুরিনি, গোটা পৃথিবীই ঘুরেছি বলা যায়। নারীও কম দেখিনি। নারীসঙ্গের সুখ কি অস্বীকার করা যায় কখনো, বলুন তো !

(চিরকুটটি জোগাড় করে দিয়েছেন রোবের্তো মৌরা)

More Articles