মতুয়ারা হাসছেন, অসম ফুঁসছে! কেন বিজেপি শাসিত অসমে CAA-র তীব্র বিরোধিতা?
Assam CAA Protest: অবৈধ বাংলাদেশি অভিবাসীদের শনাক্ত করা এবং নির্বাসনের প্রাথমিক দাবি নিয়ে ছয় বছর ধরে বিক্ষোভ চলে অসমে।
মতুয়ারা হাসছেন, আর অসমের এক বড় অংশের মানুষ ফুঁসছেন। সিএএ বা নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন কার্যকরী হওয়া ঘিরে দেশের দুই রাজ্যে দুই চিত্র। অসম বিজেপি শাসিত হলেও সিএএ না মানতে চেয়ে বিক্ষোভ চরম। পশ্চিমবঙ্গ আর অসম, বাংলাদেশ থেকে আসা শরণার্থীদের সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষ আছেন এই দুই রাজ্যেই। সিএএ যে তিন দেশের সংখ্যালঘুদের নাগরিকত্ব দেবে তাদের মধ্যে বাংলাদেশ লাগোয়া এই দুই রাজ্যে সিএএ-র কার্যকারিতার এক অন্য ভূমিকা আছে। ২০১৯ সালে ভারতীয় সংসদে পাস হয়েছিল নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন বা CAA। গত ১১ মার্চ তা কার্যকর হয়েছে।
নতুন নাগরিকত্বের নিয়মগুলি অসমের লক্ষ লক্ষ হিন্দুদের মনে এক অন্য শঙ্কার জন্ম দিয়েছে। এনআরসি-তে ভারতের প্রকৃত নাগরিক হওয়ার উপর জোর দেওয়া হয়েছিল। সিএএ অনুযায়ী নাগরিকত্ব পেতে হলে এখন মানুষকে আগে নিজেদেরকে বাংলাদেশ, পাকিস্তান বা আফগানিস্তানের বলে ঘোষণা করতে হবে।
অসমে বাংলাভাষী অভিবাসীদের বিরুদ্ধে আগে দীর্ঘ, সহিংস আন্দোলন হয়েছে। সিএএ কার্যকর হতেই সেই রাজ্যে ৩০টি অরাজনৈতিক সংগঠন এবং অল অসম স্টুডেন্টস ইউনিয়ন (AASU) শান্তিপূর্ণ গণ বিক্ষোভের ডাক দিয়েছে। অসম জাতীয় পরিষদের সভাপতি লুরিনজ্যোতি গগৈ বলছেন, এই দিন অসমের 'কালো দিন'। ২০১৯ সালে সিএএ ঘিরে উত্তপ্ত হয়েছিল অসম। সহিংস বিক্ষোভে প্রাণও গিয়েছে মানুষের। সেই আতঙ্ক ফিরছে আবার।
আরও পড়ুন- CAA: নাগরিকত্বের নামে ভোট টানতে হিন্দুদের মধ্যেই বিভাজন করে ফেলছে বিজেপি?
কিন্তু অসমের এক বড় অংশ কেন এত সিএএ বিরোধী? CAA বলছে বাংলাদেশ, পাকিস্তান এবং আফগানিস্তান থেকে আসা অমুসলিম মানুষদের ভারতের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। যারা এই দেশগুলি থেকে ধর্মীয় কারণে অত্যাচারিত হয়ে ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বরের আগে ভারতে এসেছিলেন তাঁদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে প্রকৃত নথি দেখালে। নতুন আইনের অধীনে, এই দেশগুলি থেকে আসা সংখ্যালঘু মানুষকে অবশ্যই কমপক্ষে গত এক বছর ভারতে বসবাস করতে হবে এবং বিগত ১৪ বছরের মধ্যে অন্তত পাঁচ বছর ধরে ভারতেই থাকতে হবে।
পশ্চিমবঙ্গ এবং অসমে বাংলাদেশি অভিবাসীদের নাগরিকত্ব দেওয়ার পাশাপাশি ভারত ভাগের পরে দিল্লি, রাজস্থান এবং জম্মু ও কাশ্মীরে বসতি স্থাপন করা হিন্দু এবং শিখ অভিবাসীদেরও নাগরিকত্ব দেওয়া হবে।
এই আইনটি নিপীড়নের কারণে পালিয়ে আসা ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের আশ্রয় দেওয়ার কথা বলে। কিন্তু অসম এনআরসি-র পক্ষে হলেও সিএএ বিরোধী। অসম মনে করে সিএএ অসমের নিজস্ব জনসংখ্যা এবং সাংস্কৃতিক পরিচয়কে নষ্ট করে দেবে। ১৯৬০-এর দশক থেকে অসম রাজ্যে অবৈধ অভিবাসীদের চিহ্নিত করে বিতাড়িত করার দাবি উঠেছে। এই অভিবাসীরা বেশিরভাগই বাংলাভাষী।
অবৈধ বাংলাদেশি অভিবাসীদের শনাক্ত করা এবং নির্বাসনের প্রাথমিক দাবি নিয়ে ছয় বছর ধরে বিক্ষোভ চলে অসমে। ১৯৭৯ থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত চলা এই অসম আন্দোলন প্রথমে অহিংস থাকলেও পরবর্তী পর্যায়ে হিংসাত্মক হয়ে যায়। অল অসম স্টুডেন্টস ইউনিয়ন এবং অল অসম গণসংগ্রাম পরিষদ ছিল অসম আন্দোলনের প্রধান চালিকা শক্তি। অবশেষে ১৯৮৫ সালে অসম অ্যাকর্ড নামে একটি চুক্তি হয়।
রাজীব গান্ধির নেতৃত্বাধীন কেন্দ্র সরকার, অসম সরকার, AASU এবং AAGSP ওই চুক্তি স্বাক্ষর করে। তাতে বলা হয় ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চের পর ওই রাজ্যে প্রবেশকারী 'বিদেশিদের' শনাক্ত করে নির্বাসন দেওয়া হবে। এই অভিবাসী সমস্যা সমাধানের জন্য, অসম দু'বার ন্যাশনাল রেজিস্টার অফ সিটিজেনস বা এনআরসি পরিচালনা করেছে, একবার ১৯৫১ সালে আর একবার ২০১৯ সালে। ২০১৯ সালেই নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল পাস হয়েছিল।
প্রায় পাঁচ দশক পরে বলা হচ্ছে সিএএ ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বরের আগে ভারতে পালিয়ে আসা হিন্দু উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্ব দেবে। অসম বলেছিল ১৯৭১-এর পর আসা কাউকে রাজ্য থেকে তাড়ানো হবে। বিজেপি সরকার এখন বলছে ২০১৪ সাল অবধি যারা এসেছেন তারা থাকবেন!
অসমে কয়েক দশক ধরে অভিবাসন চলায় রাজ্যের ৩৫টি জেলার মধ্যে ১০টিরও বেশি জেলায় জনসংখ্যাগত পরিবর্তন হয়েছে ব্যাপক। অসমের অনেকেই বিশ্বাস করেন এই বাংলাদেশিরা অবৈধ অভিবাসী। যে ধর্মেরই হোক না কেন তারা আসলে অসমের আদিবাসীদের ভাষা, সংস্কৃতি এবং জনসংখ্যাকে বিপদে ফেলবে।
আরও পড়ুন- রমজান শুরুর দিনটিই কেন সিএএ ঘোষণার জন্য বেছে নিলেন মোদি?
তবে পশ্চিমবাংলায় বাংলাদেশ থেকে আগত মতুয়ারা সিএএ কার্যকরী হওয়াতে আনন্দিত। সিএএ চালু হওয়াতে লক্ষ লক্ষ হিন্দু বাংলাদেশি অভিবাসী, যাদের বেশিরভাগই তপশিলি মতুয়া সম্প্রদায়ের, যারা ১৯৭১ সালের পরে ভারতে এসেছিলেন, তারা নাগরিকত্ব পাবেন।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) সাধারণ জনগণ পশ্চিম পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে নামে। পাকিস্তানি সৈন্যরা, ইসলামিক দলগুলোর সমর্থনে হিন্দুদের গণহত্যা করে, মহিলাদের ধর্ষণ করে নির্বিচারে, যার ফলে এই মানুষরা প্রাণ বাঁচাতে ভারতে পালিয়ে আসেন। ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুসারে, মতুয়ারা পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যার ১৭%। বাংলায় ৩৯টি বিধানসভা আসনে ২০ শতাংশের বেশি মতুয়া ভোট রয়েছে। নদিয়া, উত্তর ২৪ পরগনা, দক্ষিণ ২৪ পরগনা এবং পূর্ব বর্ধমান জেলায় মতুয়ারা আছেন। এই মতুয়াদের ভোটের অধিকার আছে কিন্তু নাগরিকত্বের শংসাপত্র নেই।
এনআরসি এবং সিএএ-র বিষয়টি খুব একটা সহজ নয়। অসমে এনআরসি প্রক্রিয়ার জন্য যারা আবেদন করেছেন তারা ভারতীয় নাগরিক হওয়ার প্রমাণ দিয়েছেন। তবে, নতুন আইনের অধীনে এবার নাগরিকত্ব পেতে সেই জনগণকে ঘোষণা করতে হবে যে তারা বাংলাদেশ, পাকিস্তান বা আফগানিস্তানের নাগরিক। এছাড়াও ভারতে প্রবেশের তারিখ জানাতে হবে। নিজেদেরকে বাংলাদেশি হিসাবে ঘোষণা করে যদি আবেদন খারিজ হয়ে যায় তাহলে তাঁদের কী হবে? অসমে পরিচালিত ২০১৯ সালের এনআরসি অনুযায়ী, ১৯.৬ লক্ষ মানুষ প্রমাণই করতে পারেননি যে তাঁরা ভারতীয় নাগরিক। তাদের মধ্যে প্রায় পাঁচ থেকে সাত লাখ মানুষ বাংলাভাষী হিন্দু এবং ৬০,০০০ জন অসমিয়া-ভাষী হিন্দু।