অনেকক্ষণ জলে থাকলে কুঁচকে যায় হাত পা, পূর্বপুরুষদের সঙ্গে চমকে দেওয়া যোগ পেলেন বিজ্ঞানীরা

Skin Wrinkle in Water: আগে মানুষ জুতো বা পোশাক কিছুই পরতো না। সারাদিন ভিজে মাটিতেই কাটাতে হতো তাদের। সেই পরিবেশে থাকতে থাকতেই এই অভিযোজন ঘটেছে মানুষের মধ্যে।

খানিকক্ষণ জল ঘাঁটলেই হাতের পাতা, পায়ের চামড়া কুঁচকে কিশমিশের মতো হয়ে যায়। এই ঘটনা আমরা সকলেই লক্ষ্য করেছি। কিন্তু কখনও ভেবে দেখেছেন কেন এমন হয়? আরও একটি বিষয় চোখে পড়ার মতো। তা হল, বহুক্ষণ জলে নিমজ্জিত থাকলেও শুধুমাত্র হাতের এবং পায়ের চামড়াই কুঁচকে যায়। শরীরের অন্যান্য অংশের চামড়ার কিন্তু এমন হয়না। সম্পূর্ণভাবে শরীর ডুবে গেলেই একমাত্র দেহের চামড়া কুঁচকে ওঠে। বিজ্ঞানীরা বহু যুগ ধরেই এই বিষয় নিয়ে গবেষণা করছেন। বিজ্ঞানীরা বোঝার চেষ্টা করেছেন কুঁচকে যাওয়া ত্বকের সঙ্গে আমাদের শরীরের কী সম্পর্ক রয়েছে। গবেষণায় যা উঠে এসেছে তা অবাক করবে আমাদের সকলকে।

গবেষণার ইতিহাস

গবেষণার সময় দেখা গেছে, ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় থাকা জলে ৩.৫ মিনিট ধরে হাত ডুবিয়ে রাখলেই তা কুঁচকে যেতে শুরু করবে। অন্যদিকে জলের তাপমাত্রা ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে অর্থাৎ তুলনামূলকভাবে ঠান্ডা জলে প্রায় ১০ মিনিট পর থেকেই এই ঘটনা লক্ষ্য করা যায়। আবার বেশিরভাগ গবেষণাতেই দেখা গেছে যে ৩০ মিনিটেরও বেশি সময় হাত পা জলে থাকলে হাতের বলিরেখা সর্বোচ্চ মাত্রায় পৌঁছচ্ছে। প্রথমদিকে বিজ্ঞানীরা মনে করেছিলেন যে হাতের কোশগুলির উপর দিয়ে জল প্রবাহের ফলে ত্বক কুঁচকে যেতে শুরু করে। অভিস্রবন পদ্ধতিতে জল ত্বকের কোশগুলির মধ্যে প্রবেশ করে জল এবং ত্বকের কোশের মধ্যে সমতা রক্ষা করার ফলস্বরূপ এমন ঘটে। কিন্তু ১৯৩৫ সালের এক গবেষণা বিজ্ঞানীদের ধারণা বদলে দেয়। বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারেন ত্বকের বলিরেখা তৈরির প্রক্রিয়া সঙ্গে আরও বিষয় জড়িয়ে রয়েছে।

আরও পড়ুন- নতুন টালা ব্রিজে মজে কলকাতা! উচ্ছেদ হওয়া শ্রমজীবী-বস্তিবাসীদের সুদিন আসছে কবে?

চিকিৎসকরা আহত রোগীদের পরীক্ষা করে দেখেছেন, যেসব আহত রোগীদের মিডিয়ান স্নায়ু আঘাতের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাঁদের ক্ষেত্রে ত্বক কুঁচকে যায় না। এই স্নায়ু উত্তেজনা হাতের পাতা থেকে মস্তিষ্কে বহন করে নিয়ে যায়। তাঁদের গবেষণায় দেখা যায় আমাদের স্নায়ুতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণের ফলেই ত্বক কুঁচকে যায়। পরবর্তীকালে ১৯৭০-এর দশকে চিকিৎসকরা আরও একটি পরীক্ষা করেন। ওই পরীক্ষায় জলে দীর্ঘক্ষণ হাত ডুবিয়ে রাখার ফলে স্নায়ুতন্ত্রের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত কার্যকলাপে কী প্রভাব পড়ছে তা বোঝার চেষ্টা করেন।

কেন কুঁচকে যায় ত্বক?

বিশেষজ্ঞদের মতে, চামড়ার উপরিভাগে সিবাম নামক একটি তৈলাক্ত পদার্থ উপস্থিত থাকে। এর কাজ হল চামড়াকে রক্ষা করা আর ত্বকের আর্দ্রতা বজায় রাখা। তবে বেশিক্ষণ হাত জলে থাকলে বা জলের কাজ করলে সিবাম ধুয়ে যায়। ফলে চামড়ার মধ্য দিয়ে জল প্রবেশ করতে শুরু করে তাই আঙ্গুলের ত্বক ওইভাবে কুঁচকে ওঠে।

জেনে রাখা প্রয়োজন আমাদের ত্বকের তিনটি স্তর রয়েছে।

১. এপিডারমিস,
২. ডারমিস
৩. হাইপোডারমিস।

এই এপিডারমিস স্তরে কোনও স্নায়ু থাকে না। স্নায়ু থাকে ত্বকের দ্বিতীয় অর্থাৎ ডারমিস স্তরে। ২০০৩ সালে এক গবেষণায় দেখা যায়, অনেকক্ষণ ধরে হাত জলে ডুবিয়ে রাখার ফলে হাতের রক্তবাহী নালীতে রক্তের পরিমাণ মাত্রাতিরিক্ত হারে হ্রাস পেয়েছে। চিকিৎসকরা আরও জানান, হাত জলে থাকলে তা একবারে সাদা দেখায় এর কারণও হল রক্তপ্রবাহ কমে যাওয়া। চিকিৎসক ওয়াইল্ডার স্মিথ এবং তাঁর সহকারী গবেষকরা জানান, অনেকক্ষণ ধরে হাত জলে ডুবিয়ে রাখার ফলে ত্বকে উপস্থিত ঘর্মগ্রন্থির মধ্যে জল প্রবেশ করতে শুরু করে এবং এর ফলে আমাদের দেহে লবণের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়। লবণের পরিমাণ পরিবর্তনের বার্তা হাতে উপস্থিত নার্ভে পৌঁছলে স্বেদনালীর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে থাকা রক্তনালীগুলি কুঁচকে যেতে শুরু করে। এর ফলে আঙ্গুলের মাংসল অংশের আয়তন কমে যায় এবং ত্বক কুঁচকে যেতে শুরু করে। এই কারণে লবণাক্ত জলের তুলনায় মিষ্টি জলে চামড়া বেশি কুঁচকে যায়।

আরও পড়ুন- প্রথমবার বাবা হওয়ার পর আয়তনে হ্রাস পাচ্ছে মস্তিষ্ক! নতুন গবেষণায় চাঞ্চল্য বিজ্ঞানমহলে

বিবর্তনের ফলাফল

গবেষকদের মতে, এর সঙ্গে আমাদের পূর্বপুরুষদের জীবনযাত্রার সম্পর্ক রয়েছে। আগে মানুষ জুতো বা পোশাক কিছুই পরতো না। সারাদিন ভিজে মাটিতেই কাটাতে হতো তাদের। সেই পরিবেশে থাকতে থাকতেই এই অভিযোজন ঘটেছে মানুষের মধ্যে। হাতে জল প্রবেশ করলে কোনও বস্তু শক্তভাবে ধরার ক্ষমতা অনেক কমে যায়। তাই ভেজা অবস্থাতেও হাতের গ্রিপ বজায় রাখতে এই পরিবর্তন ঘটে। ২০১৩ সালে নেচার পত্রিকায় প্রকাশিত একটি রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, জলের মধ্যে কুঁচকে যাওয়া ত্বকের কোনও কিছু আকড়ে ধরে রাখার ক্ষমতা অকুঞ্চিত ত্বকের তুলনায় ১২% বেশি। অন্যদিকে পায়ের পাতা কুঁচকে যাওয়ার সুবিধা হল, ভেজা রাস্তার ওপর দিয়ে আমরা যেন সহজেই হেঁটে যেতে পারি।

তবে হাত ও পায়ের ত্বক সবসময় কুঁচকে থাকে না কেন?

এর কারণ হিসেবে বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, সর্বদা কুঁচকে থাকলে ত্বকের সংবেদনশীলতা (কোনও কিছু উপলব্ধি করার ক্ষমতা) হ্রাস পায়। তাই কেবল প্রয়োজনের সময়েই চামড়া কুঁচকে যেতে দেখা যায়।

More Articles