ভারতের দুর্নীতি মেটাতে 'লোকপাল' মোদি ঘনিষ্ঠ বিচারপতি! খানউইলকর আসলে কে?

Lokpal Khanwilkar : নরেন্দ্র মোদি এবং তাঁর দল বিজেপি অত্যন্ত সুচতুরভাবে সাংবিধানিক সমস্ত পদে নিজেদের পছন্দমাফিক লোককে বসিয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন কমিটি পরবর্তী লোকপাল হিসেবে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি খানউইলকরের নাম বেছে নিয়েছে। লোকপালের ভূমিকা কী? ভারতে দুর্নীতি দমনের জন্য লোকপাল পদটি সৃষ্টি করা হয়েছে। ২০১৪ সালের আগে দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলনই ছিল, নরেন্দ্র মোদির সর্বভারতীয় ভাবমূর্তি গড়ে তোলার অন্যতম হাতিয়ার। দুর্নীতি দমনকারী সংস্থার প্রধানের নাম সরকারিভাবে ঘোষিত হয়ে যাওয়ার পরে বেশ কিছু কথা উঠে আসছে। প্রধানমন্ত্রী ছাড়াও লোকসভার স্পিকার, লোকসভায় বৃহত্তম বিরোধী দলের নেতা অধীর চৌধুরী, প্রধান বিচারপতি ও তাঁর মনোনীত বিচারপতি ওই কমিটির সদস্য। এই সমস্ত মানুষজন মিলে কী করে এই সিদ্ধান্ত নিলেন, তা নিয়ে অবশ্য প্রশ্ন থাকতে পারে। তবে আপাতত আলোচনা করা জরুরি, কেন বিচারপতি খানউইলকরকেই বেছে নেওয়া হলো পরবর্তী স্থায়ী লোকপাল হিসেবে। তাহলে কি প্রধান বিচারপতি, যিনি নানা সময়ে গণতন্ত্রিক রীতিনীতি সংক্রান্ত বক্তব্য রেখে থাকেন, তিনিও কি তবে সরকারের পছন্দতেই সায় দিলেন? ২০২২ সালের জুলাই মাসে অবসর নেন এই বিচারপতি। তার আগে তিনি যে সমস্ত রায় দেন, সেদিকে নজর দিলেই বোঝা যাবে কেন এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

বিশ্লেষকরা দেখছেন, নরেন্দ্র মোদি এবং তাঁর দল বিজেপি অত্যন্ত সুচতুরভাবে সাংবিধানিক সমস্ত পদে নিজেদের পছন্দমাফিক লোককে বসিয়েছে। মুখ্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ করতে গিয়ে বিজেপি দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায়কে সংসদে বদল অবধি করে ফেলেছে। যে বা যাঁরা নরেন্দ্র মোদিকে বিভিন্নভাবে সহায়তা করেছেন, তাঁদের তিনি পুরস্কৃত করতে দ্বিধা করেননি। যার সাম্প্রতিকতম উদাহরণ, স্থায়ী লোকপাল নিয়োগের ক্ষেত্রে তিনি বেছে নিয়েছেন এমন একজন মানুষকে, যিনি বিচারপতি থাকাকালীন এমন সব রায় দিয়েছেন যাতে নানান ক্ষেত্রে নরেন্দ্র মোদি এবং তাঁর সরকারের সুবিধা হয়।

আরও পড়ুন- নরেন্দ্র মোদি ওবিসি নন?

সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যাচ্ছে, ইডি এবং সিবিআইকে শুধুমাত্র বিরোধী দলের নেতা মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। বিরোধী দলগুলোর
দুর্নীতিগ্রস্ত নেতাদের বিরুদ্ধে একদিকে বিজেপি প্রচার করে যাবে, অন্যদিকে ইডি এবং সিবিআইকে দিয়ে দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত নেতাদের কখনও চাপ দিয়ে দলবদল করানো হচ্ছে, কখনও গ্রেপ্তার করানো হচ্ছে। সবার ক্ষেত্রেই প্রিভেনশন অফ মানি লন্ডারিং অর্থাৎ PMLA বিষয়টিকেই সামনে আনা হচ্ছে। এতদিন অবধি নিয়ম ছিল, একজন অভিযুক্ত যতক্ষণ না দোষী প্রমাণিত হচ্ছেন, ততদিন অবধি তাঁকে গ্রেপ্তার করা গেলেও, কোনও চার্জশিট না দিয়ে জেলে রাখা যাবে না। তিনি জামিন পাওয়ার অধিকারী। বিচারপতি খানউইলকর অবসরের আগে এই আইন সংক্রান্ত বিষয়ে এমন একটি রায় দেন, যাতে যে কোনও কাউকেই এই তদন্তকারী সংস্থা গ্রেপ্তার তো করতে পারবেই, উপরন্তু তাঁর জামিনও হবে না। শুধু তাই নয়, এই রায় দেওয়ার সময়ে তিনি লেখেন, কোনও ব্যক্তি ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃতভাবে যদি কোনও ধরনের আর্থিক নয়ছয়কে ঢাকা দেওয়ারও চেষ্টা করেন, তাহলে তিনি সমান দোষী এবং তদন্তকারী সংস্থারা ইচ্ছে করলেই তাঁদের গ্রেপ্তার করে, জেলে রাখতেই পারে। ফলে বোঝাই যাচ্ছে, এই আইনকে এতটা আগ্রাসী বানানোর ফলে আখেরে কার লাভ হয়েছে।  যদিও বিরোধীরা বারবার তথ্য সহকারে দেখানোর চেষ্টা করেছে যে ইডি, সিবিআই যতজনকে PMLA-তে গ্রেপ্তার করেছে, তার খুব ন্যূনতম অংশের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেওয়া হয়েছে গত আট বছরে কিন্তু তাতেও সরকার কর্ণপাত করেনি। সরকারের উদ্দেশ্য খুব পরিষ্কার, বিরোধী দলের নেতা, মন্ত্রী, সংগঠকদের নানা অজুহাতে জেলে ঢুকিয়ে, তাঁদের সাংগঠনিকভাবে দুর্বল করে দেওয়া। এই কাজে পরোক্ষে বিজেপিকে যিনি আইনিভাবে সবচেয়ে বেশি সহায়তা করেছিলেন, তিনি বিচারপতি খানউইলকর। সুতরাং তাঁকে লোকপাল করে পুরস্কৃতই করলেন মোদি।

অবশ্য বিচারপতি খানউইলকার শুধুমাত্র এই রায়ের জন্যেই বিখ্যাত হয়েছেন, তা নয়। তাঁর আরও বেশ কিছু রায়ের ফলে সরকার এবং বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী নিজে উপকৃত হয়েছেন। ২০০২ সালে, গুজরাতে সাম্প্রদায়িক হিংসায় অন্যতম ঘটনা ছিল গুলবার্গ সোসাইটি। সেখানে খুন হন কংগ্রেস নেতা এহসান জাফরি। সেই ঘটনায় গুজরাতের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী, নরেন্দ্র মোদির হাত ছিল বলে এহসান জাফরির স্ত্রী, জাকিয়া জাফরির তরফে দেশের সর্বোচ্চ আদালতে মামলা করেন। সেই মামলায় অন্যতম একজন সহকারী ছিলেন সমাজকর্মী তিস্তা শীতলবাদ। বিচারপতি খানউইলকর, সেই মামলা শুধু খারিজ করে দিয়েছিলেন তাই-ই নয়, তিস্তা শীতলবাদের উদ্দেশ্য নিয়েও প্রশ্ন তুলেছিলেন। বিচারপতি বলেছিলেন, এত পুরনো একটা ঘটনা জিইয়ে রাখার জন্য কেন তিস্তাকে গ্রেপ্তার করা হবে না? তারপরেই তিস্তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। 

আরও পড়ুন- স্থানীয় থেকে জাতীয় লাফ! মোদির কুসুম বিছানো পথে কাঁটার নাম কেজরি?

নয়াদিল্লিতে সেন্ট্রাল ভিস্তা এবং নতুন সংসদ ভবন তৈরির সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে বেশ কয়েকজন সমাজকর্মী এবং পরিবেশবিদ মামলা করেছিলেন। সেই মামলা যে বেঞ্চে ছিল সেই বেঞ্চেরও নেতৃত্বে ছিলেন তৎকালীন বিচারপতি এএম খানউইলকার। সেই বেঞ্চের নির্দেশেই সেন্ট্রাল ভিস্তা তৈরির শেষ আইনি বাধাও কেটে যায়। শবরীমালা মামলার বেঞ্চেও ছিলেন তিনি। বিচারপতি হিসেবে প্রথমে বম্বে হাইকোর্টে দায়িত্ব সামলেছেন তিনি। পরে হিমাচল প্রদেশের প্রধান বিচারপতি হন তিনি। তারপরে মধ্যপ্রদেশের হাইকোর্টেও প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব সামলেছেন। তারপরে ২০১৬ সালে সুপ্রিম কোর্টে বিচারপতি হিসেবে যোগ দেন। ২০২২ সালের এপ্রিল মাসে তিনি বেসরকারি সংস্থাদের বিদেশ থেকে পাওয়া অর্থ সংক্রান্ত একটি রায় দেন (FCRA) যার ফলে এই সংস্থাদের কাজ করা প্রায় বন্ধ বা দুষ্কর হয়ে উঠেছে। বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা নানা সময়েই সরকারের সমালোচনা করে থাকে। তাই তাঁদের আর্থিকভাবে পঙ্গু করতেই কি এমন রায়? প্রশ্ন ওঠে তখনও। আধারের ক্ষেত্রেও তিনি সরকারের যুক্তিকেই মান্যতা দেন। ইউএপিএতে হোক বা অন্য যে কোনও আইনের ক্ষেত্রেই, যে কোনও অভিযুক্ত আগে জামিনের অধিকারী ছিলেন কিন্তু বিচারপতি খানউইলকর সেই ধারণাও বদলে দেন। নাগরিকদের স্বাধীনতা সংক্রান্ত যে কোনও বিষয়ে তিনি প্রায় সব সময়ই রাষ্ট্রের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। 

প্রচলিত একটা ধারণা আছে, অবসরের পরে যদি কোনও বিচারপতিকে সরকারের পক্ষ থেকে আবার কোনও সাম্মানিক পদে বসানো হয়, তাহলে বোঝা যায় তিনি সরকারের কতটা কাছের ছিলেন। তাঁর রায়ের ফলে সরকারের কী ধরনের সুবিধা হয়েছে, তা বুঝতে গেলে অবসরের পরে, তাঁর অবস্থান দেখলেই যথেষ্ট। রঞ্জন গগৈ রামমন্দিরের রায়ের অন্যতম একজন বিচারক ছিলেন, তাঁকে রাজ্যসভার সদস্যপদ দেওয়া হয়েছে। বিচারপতি খানউইলকরকেও, সরকারকে সমর্থন করার জন্যই লোকপাল করার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। অথচ আমাদের কাছে কিন্তু বিচারপতি চেলামেশ্বর কিংবা বিচারপতি নরিম্যানের উদাহরণও আছে। তাঁদের শুধু বিচারপতি হিসেবে দেখা উচিতই নয়। তাঁদের সময়কালে, তাঁরা যেমন সরকারের সমালোচনা করেছেন নানান প্রশ্নে, তেমনই অবসরের পরেও তাঁরা কিন্তু অবসরকালীন ভাতা বা পেনশন নিয়ে চুপ করে বসে যাননি। সাম্প্রতিক সময়েও সরকারের নানা জনবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হচ্ছেন তারা। কোনও কোনও মানুষের মেরুদণ্ড আজও ঋজু। সরকারি ‘লোকপাল’ পদ পাওয়ার বাসনায় তা বেঁকে যায় না।

More Articles