বাঁদরেরই জাত ভাই! তবে কেন মানুষের মতো বুদ্ধি ধরে না অন্য কোনও প্রাণীই?
Human Brain: মস্তিষ্কে নিউরোনের অন্তর্জাল বা নিউরোনাল নেটওয়ার্ক সাধারণত আমাদের অভিজ্ঞতা এবং অভ্যেসের সঙ্গে সঙ্গে বদলায়। যাকে বিজ্ঞানের ভাষায় বলে ব্রেন প্লাস্টিসিটি
মানুষ সবথেকে বুদ্ধিমান প্রাণী কীভাবে হলো? বানর, শিম্পাঞ্জি, বনোবোর মতো প্রাইমেটকে আমাদের খুব নিকট আত্মীয় বলা হলেও, কেনই বা তারা এত বুদ্ধিমান নয়? পৃথিবীর বুকে মানুষই একমাত্র জীব যারা সভ্যতা গড়ে তুলেছে, ইমারত বানিয়েছে, জীবনদায়ী ওষুধ বানিয়েছে, কবিতা আর গানের ভাষায় পৃথিবীকে নমনীয় সুখ জুগিয়েছে, আবার সভ্যতাগ্রাসী বোমাও বানিয়েছে। অথচ অন্যান্য প্রাণী তা পারেনি কেন? সমাজ-সভ্যতা ও জীবন নিয়ে ভাবতে ভাবতে নিশ্চুপে বসে বা ভিড়ে মিশে গিয়ে আমরা সবাই কখনও না কখনও কি এমনটা ভেবেছি?
বেশ কিছুদিন আগের ‘নেচার’-এ প্রকাশিত এক গবেষণা উত্তর দিল সেই সুপ্রাচীন প্রশ্নের। জীবকূলে মানুষের মস্তিষ্ক যে সবচেয়ে জটিল তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। দীর্ঘ অভিযোজন আর বিবর্তনের পাথরে ঘষা খেতে খেতে আজ মানবমস্তিষ্ক এই জটিল স্তরে পৌঁছেছে, সে যে সুসংবদ্ধ হতে শিখেছে, সেও আমাদের অজানা নয়। অভিযোজন আর বিবর্তনের দীর্ঘ রাস্তা অতিক্রমের বহু আগেই যদি কোনও প্রাণী আগুন বা চাকার আবিষ্কার করে থাকে, তাহলে সে মানুষ ছাড়া আর কেউ না। এত সুপ্রাচীন মস্তিষ্ক কীভাবে প্রাথমিক মানবসভ্যতার দু’টি চাবিকাঠি আবিষ্কার করে ফেলেছিল, তার উত্তরও লুকিয়ে আছে এই গবেষণাতেই।
আরও পড়ুন- মানুষ এক ছোবলেই ছবি! তবে কোন রহস্যে সাপের তীব্র বিষেও বেঁচে যায় বন্য প্রাণীরা?
মস্তিষ্ক কীভাবে কাজ করে, সেই বিষয়ে আমাদের ধারণা বদলেছে বিশদ গবেষণার সঙ্গে সঙ্গে। বর্তমান যে তাত্ত্বিক মডেল মানব-মস্তিষ্কের বর্ণনা দেয়, তাকে বলে ‘ডিস্ট্রিবিউটেড ইনফর্মেশন-প্রসেসিং সিস্টেম’। এই তাত্ত্বিক মডেল অনুযায়ী, মানুষের মস্তিষ্কে সুস্পষ্ট কিছু অংশ রয়েছে যারা বিভিন্ন ধরনের কাজ করে এবং এই অংশগুলিই মস্তিষ্কে সুসংবদ্ধ অন্তর্জাল বা নেটওয়ার্ক তৈরি করে। আর সেই নেটওয়ার্কগুলি তৈরি করে নার্ভকোশ বা নিউরোন। এত সুসংবদ্ধ এবং সুসংগঠিত নিউরোনের নেটওয়ার্ক অন্য কোনও প্রাণীর নেই। আর মস্তিষ্কের ভিন্ন ভিন্ন এই অঞ্চলগুলি নিজেদের মধ্যে তথ্য আদান প্রদান করে ইনপুট এবং আউটপুট সংকেতের সাহায্যে। ঠিক যেমনটা দেখা যায় কম্পিউটারে। এই গবেষণাতেই দেখা যাচ্ছে, নিজেদের মধ্যে আদান প্রদানের জন্যে মস্তিষ্কের এক একটি অঞ্চল এক এক রকমের পদ্ধতি অবলম্বন করে।
নতুন গবেষণাটি থেকে এও জানা যাচ্ছে, মস্তিষ্ক কিন্তু কেবল এক ধরনের তথ্যের আদান প্রদান করে না। এখানে আদান প্রদান হয় বিভিন্ন ধরনের তথ্যের। এবং যেভাবে এই তথ্যের প্রক্রিয়াকরণ হয়, তার পদ্ধতি শিম্পাজি, বানর বা বনোবোর মতো প্রাইমেটদের থেকে বহুগুণে আলাদা তো বটেই, এবং উন্নতও। আর তথ্যের প্রক্রিয়াকরণের এই ভিন্নতা যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, প্রাণী হিসেবে মানুষ এত উন্নত কেন।
দেখা যাচ্ছে, মস্তিষ্কের যে সমস্ত অংশ সংবেদন, শব্দ, দৃষ্টি, কিংবা অঙ্গ প্রত্যঙ্গ সঞ্চালনার কাজ নিয়ন্ত্রণ করে, মস্তিষ্কের সেই অংশই প্রধানত ইনপুট এবং আউটপুটের উপর নির্ভর করে তথ্য আদান প্রদান করে। গবেষকদের মতে, ইনপুট এবং আউটপুটের উপর নির্ভর করে তথ্য আদান প্রদানের পদ্ধতি আদতেই খুব গতানুগতিক একটি পদ্ধতি।
মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশ কাজ করার সময়, নিজেদের মধ্যে সমন্বয় রেখে, সঙ্গবদ্ধভাবে কাজ করে। দেখা যাচ্ছে, মস্তিষ্কের যে যে অংশে জটিল কগনিটিভ ফাংশন- যেমন মনোনিবেশের ক্ষমতা, স্মৃতিশক্তি, গণনা করার ক্ষমতা, এবং সামাজিক সম্পর্ক বজায় রাখার মতো বিষয় নিয়ন্ত্রিত হয়, সেই অঞ্চলগুলির মধ্যে সমন্বয় রেখে কাজ করার প্রবণতা যেন আরও বেশি করে দেখা যায়। মস্তিষ্কে নিউরোনের অন্তর্জাল বা নিউরোনাল নেটওয়ার্ক সাধারণত আমাদের অভিজ্ঞতা এবং অভ্যেসের সঙ্গে সঙ্গে বদলায়। যাকে বিজ্ঞানের ভাষায় বলে ব্রেন প্লাস্টিসিটি। অথচ মস্তিষ্কের যে অংশগুলি বিভিন্ন ধরনের জটিল কগনিটিভ ফাংশন নিয়ন্ত্রণ করে, আমাদের অভিজ্ঞতা এবং অভ্যেসের কারণে সেখানকার নিউরোনাল নেটওয়ার্কের কোনও পরিবর্তন হয় না। অভিযোজন এমন ভাবেই আমাদের গড়েপিটে নিয়েছে, যে ব্রেন প্লাস্টিসিটি সেখানে দেখা যায় না।
মানুষের মস্তিষ্কে ঠিক যে যে অংশে বেশি সমন্বয় দেখা যায়, তাদের মধ্যে অন্যতম হল কর্টেক্সের একদম সামনের দিক (ফ্রন্টাল কর্টেক্স) এবং কর্টেক্সের মধ্যবর্তী অঞ্চল। কর্টেক্স আদতে মস্তিষ্কের বাইরের স্তর। কর্টেক্সের এই দু’টি অঞ্চল মস্তিষ্কের বাকি অঞ্চলগুলির সঙ্গে সুন্দরভাবে যুক্ত থাকে। আর সে জন্যই বাকি প্রাণীদের থেকে অনেক ভালো করে আমরা বিভিন্ন বিষয় অনুভব করতে পারি, চিন্তা করতে পারি, অঙ্ক কষতে পারি বা কবিতা লিখতে পারি, কিংবা পারস্পরিক সম্পর্ক বজায় রাখতে পারি।
আরও পড়ুন- প্রথমবার বাবা হওয়ার পর আয়তনে হ্রাস পাচ্ছে মস্তিষ্ক! নতুন গবেষণায় চাঞ্চল্য বিজ্ঞানমহলে
আর তখনই সেই অবধারিত প্রশ্ন মনে উঁকি দেয়। তাহলে মস্তিষ্কের বিভিন্ন অঞ্চলের এই সুন্দর সমন্বয়ই কি আমাদের বাকি প্রাণীদের থেকে আলাদা করে তুলেছে? এই সমন্বয়ই কি কারণ আমাদের মস্তিষ্কের এত উন্নত হয়ে ওঠার নেপথ্যে? আমাদের উন্নত এক জীবে পরিণত হওয়ার নেপথ্যে?
সেই প্রশ্নের পেতে গবেষকরা খুঁজে দেখেন ব্রেনের ইমেজিং ডেটা এবং একাধিক জিনগত বিশ্লেষণ। দেখা যায় ম্যাকাক বানরের মস্তিষ্কের তুলনায় মানুষের মস্তিষ্কে তথ্য প্রবাহ অনেক বেশি হারে ঘটেছে। তার নেপথ্যে দায়ী মস্তিষ্কের বিভিন্ন অঞ্চলের সমন্বয় রেখে চলা। সেই তথ্য থেকে উঠে আসে মানুষের প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স, যা কিনা বিভিন্ন কগনিটিভ ফাংশানের জন্যে দায়ী, মস্তিষ্কের সেই অংশেই সব থেকে বেশি সমন্বয় নির্ভর কাজ হয়।
বিভিন্ন ইমেজিং ডেটা এবং জিনগত বিশ্লেষণ থেকে উঠে আসা এই তথ্যের কথা মাথায় রেখে যদি বিবর্তনের ফেলে আসা পথের দিকে ফিরে তাকাই, তাহলে দেখা যাবে মানুষের প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আকারে বেড়েছে। অথচ শিম্পাজি বা অন্যান্য প্রাইমেটদের ক্ষেত্রে কিন্তু তা ঘটেনি। মস্তিষ্কের কোনও অংশের আকার তখনই বাড়ে, যখন তার যথেচ্ছ ব্যবহার হয়।
আবার দেখা যাচ্ছে, মস্তিষ্কের যে অংশে সমন্বয় ভিত্তিক কাজ বেশি হয়, সেখানেই এমন কিছু জিন বেশি সক্রিয় যারা এই সমন্বয় বজায় রাখতে সাহায্য করবে। এবং অবশেষে গবেষকরা জানাচ্ছেন, আমাদের মস্তিষ্কের প্রবণতাই হয়তো সমন্বয় রেখে কাজ করা। আর সেই প্রবণতা এবং ক্ষমতার জন্যই আমাদের বুদ্ধিমত্তা অন্যান্য প্রাণীদের থেকে বেশি।