বছরে ৩৩ হাজারের বেশি ভূমিকম্প, মৃত্যু কয়েক লাখের! কেন বারবার এমন বিপর্যয় দেখে তুরস্ক?
Turkey Earthquake Prone : ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, বারবার ভয়াবহ ভূমিকম্পের মুখে পড়েছে তুরস্ক। কখনও মাঝারি, কখনও তীব্র ভূমিকম্পের ধাক্কা লেগেছে এই দেশে।
কেউ কেউ বলছেন প্রায় ৪৬ সেকেন্ড। আবার কারও বক্তব্য, প্রায় ৩-৪ মিনিট ধরে চলেছে তাণ্ডব। যাই হোক না কেন, তার ‘ফলাফল’ যে কীরকম, সেটা দেখছে গোটা বিশ্ব। ৬ ফেব্রুয়ারি, সোমবারের সকালটা অন্যান্য দিনের মতো স্বাভাবিক হতে পারত। কিন্তু মাত্র কয়েকটি সেকেন্ডে সমস্ত কিছু এধার ওধার হয়ে গেল। তুরস্কের ভয়াবহ ভূমিকম্পের বাস্তব ছবিটা এই বর্ণনার থেকেও আরও কয়েকগুণ ভয়ংকর। এখনও অবধি ৫০০-রও বেশি মানুষ মারা গিয়েছেন। ২৫০০-র বেশি মানুষ গুরুতর আহত। ভোররাতে ভূমিকম্প হওয়ায় অনেকেই ঘুম ভেঙে বেরোতে পারেননি। তাই প্রশাসনের আশঙ্কা, এই হতাহতের সংখ্যাটা আরও কয়েকগুণ বাড়বে। চারিদিকে ধ্বংসস্তূপের মধ্যে নিজেদের সামগ্রী খুঁজে নিচ্ছেন বাসিন্দারা।
তুরস্ক প্রশাসন জানিয়েছে, ১০ টি জেলায় অন্তত ১৭০০টি বাড়ি একেবারে ভেঙে পড়েছে। ৭.৮ তীব্রতার ভূমিকম্প এবং ৬.৭ তীব্রতার আফটার শক – তারপরও বেশ কয়েকজন ভাগ্যক্রমে বেঁচে গিয়েছেন। তাঁদের চোখে মুখে এখনও লেগে রয়েছে আতঙ্কের ছাপ। জানলাগুলো ভেঙে চুরমার হয়ে পড়ছে। তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ছে বাড়ি। সেইসঙ্গে রয়েছে প্রবল ঠাণ্ডা। এতগুলো মানুষ, যাঁদের ঘরবাড়ি রাতারাতি ভেঙে গুঁড়িয়ে গিয়েছে, তাঁরা এখন থাকবেন কোথায়? তাঁদের প্রিয়জনদের কি খুঁজে পাওয়া গিয়েছে? এই শঙ্কাতেই দিন কাটাচ্ছেন তাঁরা।
আরও পড়ুন : ঘুমের মধ্যেই ৫০০-রও বেশি মৃত, শতাব্দীর অন্যতম ভয়াবহ ভূমিকম্পে যে বীভৎস ছবি দেখল তুরস্ক
তবে এমন ঘটনা তুরস্কে প্রথম নয়। ৬ ফেব্রুয়ারির ভূমিকম্পের রেশ ছড়িয়ে পড়েছে সিরিয়া, লেবানন, গ্রিস, সাইপ্রাসের মতো দেশগুলোতেও। সুনামির আশঙ্কাও করা হচ্ছে। কিন্তু ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, বারবার ভয়াবহ ভূমিকম্পের মুখে পড়েছে তুরস্ক। কখনও মাঝারি, কখনও তীব্র ভূমিকম্পের ধাক্কা লেগেছে এই দেশে। মৃত্যুর সংখ্যা কখনও ১০০, কখনও ১৭,০০০। শতাব্দীর ভয়ংকর ভূমিকম্পগুলির মধ্যে বেশ কয়েকটি ঘটে গিয়েছে খোদ তুরস্কেও।
যেমন ধরা যাক ১৯৯৯ সালের ১৭ আগস্টের ঘটনা। তুরস্কের মারমারা প্রদেশে ভয়াবহ ভূমিকম্প ঘটে। ঘটনাচক্রে, এটিও ভোরের দিকেই হয়েছিল। রিখটার স্কেলে ৭.৪ তীব্রতার এই ভূমিকম্পের শেষে দেখা যায়, মৃতের সংখ্যা ১৭,০০০ ছাড়িয়েছে। এটা অবশ্য সরকারি হিসেব। বেসরকারি সূত্রের দাবি, মৃতের সংখ্যা প্রায় ৩৫,০০০। সেইসঙ্গে প্রায় ৫০,০০০ মানুষ আহতও হন। বাড়িঘর ধুলিস্যাৎ হয়ে যায়। ঠিক তিন মাস পর, ১২ নভেম্বরে আরও একটি ভূমিকম্প হয় তুরস্কে। ৭.০ তীব্রতার এই ভূমিকম্পের জেরে মারা যান ৮৪৫ জন মানুষ। পাঁচ হাজারেরও বেশি মানুষ আহত হন।
তুরস্কের বিপর্যয় মোকাবিলা দফতরের (Disaster and Emergency Management Authority) রিপোর্ট বলছে, স্রেফ ২০২০ সালেই ৩৩,০০০-এরও বেশি ভূমিকম্প হয়েছে তুরস্কে! এদের মধ্যে ৩০০-রও বেশি ভূমিকম্পের তীব্রতা ছিল ৪.০-র থেকে বেশি। কিন্তু এমন কেন? ভূবিজ্ঞানীরা বলছেন, এর জন্য তুরস্কের ভৌগোলিক অবস্থানই দায়ী।
আরও পড়ুন : ১ মিনিটের ভূমিকম্পেই তছনছ হতে পারে কলকাতা, কতটা বিপদ ঘনিয়ে রয়েছে শহরে?
বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, তুরস্কের বেশিরভাগ অঞ্চলই অ্যানাতোলিয়ান টেকটনিক প্লেটের ওপর অবস্থিত। এই বিশেষ প্লেটটিকে ঘিরে রয়েছে দুটো বড় প্লেট – ইউরেশিয়ান ও আফ্রিকান। পাশাপাশি রয়েছে আরব প্লেটও। প্লেটগুলির চলাচল ও একটির মধ্যে অপরটির ঢুকে পড়ার ঘটনার সরাসরি প্রভাব পড়ে তুরস্কের মূল ভূখণ্ডের ওপর। কারণ, এই প্লেটগুলির সংঘর্ষরেখার ঠিক ওপরেই রয়েছে এই দেশটি।
অ্যানাতোলিয়ান ও ইউরেশিয়ান প্লেট যেখানে এসে এক হচ্ছে, সেই জায়গাটিকে বলে উত্তর অ্যানাতোলিয়ান ফল্ট লাইন (North Anatolian fault line)। এটিই সবচেয়ে ক্ষতিকারক জায়গা। এখানেই তুরস্কের সবচেয়ে ভয়াবহ ভূমিকম্পগুলি ঘটেছে। এদিকে পশ্চিম তুরস্কেও রয়েছে আরও একটি প্লেট – অ্যাগান সি প্লেট। সমস্তটা মিলিয়ে ভূ-প্রাকৃতিক দিক থেকেই অত্যন্ত সংকটময় জায়গায় অবস্থান করছে তুরস্ক। যত দিন যাবে, এই সমস্যা আরও বাড়বে বলেই মনে করছেন বিজ্ঞানীরা। তুরস্কের প্রতিটা মানুষকে বাধ্যতামূলকভাবে ভূমিকম্প থেকে বাঁচার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। তাঁদের কাছে প্রয়োজনীয় সরঞ্জামও তৈরি থাকে। কিন্তু তবুও ঘটে যায় দুর্ঘটনা। যেমন ঘটল ২০২৩-এর ফেব্রুয়ারি মাসে।