ওজন ১৮০ কেজি, থলথলে চর্বি! তাও কীভাবে 'ফিট' থাকেন সুমো কুস্তিগীররা?

Japanese Sumo Wrestler: অবসরপ্রাপ্ত কুস্তিগীররা গড় জাপানি নাগরিকের চেয়ে আনুমানিক ১০ বছর আগেই মারা যান।

থলথলে বললেও বোধহয় কম বলা হয়। সর্বত্র চর্বির পুরু ভাঁজ, দেহ জুড়ে উথলে উঠছে চর্বি। মাসল ফোলানোর কোনও বালাই নেই। নেই স্পষ্ট, আকর্ষক 'অ্যাবস'। অথচ জাপানি সুমো কুস্তিগীরদের কথা শুনলেই কেঁপে ওঠেন মানুষ! ওজন ৩০০-৪০০ পাউন্ড, কেজির হিসেব করলে প্রায় ১৫০ থেকে ১৮০ কেজির কাছাকাছি। শরীরের ব্যাপক চর্বি জমে মূলত দেহের মধ্যভাগেই। অর্থাৎ শরীরের সেই অংশে মেদ, যা সাধারণত স্বাস্থ্য সংক্রান্ত ভয়াবহ সব ঝুঁকির মুখে ফেলতে পারে মানুষকে। তবুও সুমো কুস্তিগীররা স্বাভাবিকের তুলনায় বেশিই সক্রিয়। তাঁদের রক্তচাপ, গ্লুকোজ এবং কোলেস্টেরলও স্বাভাবিক সীমার মধ্যেই! কোন জাদুবলে এমন অসাধ্য সাধিত হয় এই সুমো কুস্তিগীরদের দেহে?

এর উত্তর খুঁজতে হলে ঘাঁটতে হবে সেই চর্বিই, অর্থাৎ জানতে হবে চর্বির প্রকারভেদ। দেহে কী ধরনের চর্বি থাকে সুমোদের তা নির্ধারণ করে দেয় স্বাস্থ্য কেমন হবে। বেশি মাত্রার শারীরিক কসরতের কারণে, একজন সুমো কুস্তিগীরের শরীরে ভিসারাল ফ্যাটের পরিবর্তে সাবকুটেনিয়াস (যার অর্থ 'ত্বকের নীচে’) চর্বি থাকে। ভিসারাল ফ্যাট হচ্ছে শরীরের সবচেয়ে বিপজ্জনক ধরনের চর্বি। এই চর্বি দেহের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলির চারপাশে জমা হয় এবং বিপাক ক্রিয়া ব্যাহত করে। সাবকুটেনিয়াস ফ্যাট ভিসারালের তুলনায় অনেক কম ঝুঁকিপূর্ণ। কেন কিছু কিছু মানুষের বিএমআই বা বডি মাস ইনডেক্স বেশি থাকা সত্ত্বেও তারা বিপাকীয়ভাবে সুস্থ থাকতে পারেন তা নির্ভর করে এই চর্বির শ্রেণির উপরেই।

তবে সবচেয়ে বিপজ্জনক অবস্থা দেখা দেয় যখন একজন সুমো কুস্তিগীর প্রশিক্ষণ বন্ধ করে দেন। সেই সময় প্রায়ই দেহের বিপাকীয় কার্যকলাপে অদ্ভুত সব পরিবর্তন দেখা দেয় কারণ তাদের শারীরিক কার্যকলাপ হঠাৎ করেই কমে যায়। যদিও এই সময় তাদের ওজন ঠিক একই থেকে যায়। শারীরিক কার্যকলাপ হ্রাস পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ত্বকের নিচের চর্বি ধীরে ধীরে বিপজ্জনক ভিসারাল ফ্যাটে রূপান্তরিত হয়। ডায়াবেটিস এবং হৃদরোগের মতো রোগ ডেকে আনে। ওজন কোনও দিনই বিপদে ফেলে না সুমোদের, বিপদে ফেলে শারীরিক কসরতই। ওজন বিপুল হলেও, এই কুস্তিগীররা যে পরিমাণ শারীরিক পরিশ্রম করেন তাতে তাদের দেহের উপর নিয়ন্ত্রণ থাকে চরম।

আরও পড়ুন- বিয়ে বাড়িতে ব্যাপক ডিজে! যে কোনও মুহূর্তে হার্ট অ্যাটাক কাড়বে আপনার প্রাণ

ইতিহাস বলছে, এডো যুগে (১৬০৩-১৮৬৮) সুমো খুব জনপ্রিয় বিনোদন হয়ে ওঠে। এটি তখনকার সবচেয়ে বড় খেলাধুলোর অন্যতম ছিল। সাধারণত উচ্ছৃঙ্খল পুরুষরা এই খেলাতে মাততেন এবং প্রায়ই অনুষ্ঠানস্থলে উত্তেজিত এবং হিংসাত্মক হয়ে উঠতেন। মহিলাদের সুমো দেখতে যেতে দেওয়া হতো না, তবে কুস্তিগীররা (যাকে রিকিশি নামে ডাকা হতো) মহিলাদের মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল।

এডো যুগের সবচেয়ে কিংবদন্তি রিকিশিদের একজনের নাম ছিল রাইডেন, উচ্চতা ১৯৭ সেমি এবং ওজন ১৬৯ কেজি! তবে সবটা সত্য কিনা তা বলার উপায় নেই। রাইডেনের যুগে গড় জাপানি পুরুষদের উচ্চতা ছিল প্রায় ১৫৫ সেমি (৫ ফুটের চেয়ে একটু বেশি)। সুতরাং তখন এত লম্বা ও স্থূল পুরুষ থাকা সম্ভব ছিল কিনা বোঝা দায়।

জাপানি স্পোর্টস ম্যাগাজিন 'নাম্বার' অনুসারে, রিকিশিরা আজ থেকে ১০০ বছর আগেও এত বিশালাকার এবং মোটা ছিলেন না। ২০১৮ সালে সেরা রিকিশির গড় ওজন: ১৬৪ কেজি (৩৬২ পাউন্ড)। ১৯৬৮ সালে ছিল, ১৩০.৬ কেজি (২৮৭ পাউন্ড)। ১৯১৮ সালে তা ছিল ১০২.৯ কেজি (২২৫ পাউন্ড)। সুমো কুস্তিগীররা দিনে ৭,০০০ ক্যালোরি পর্যন্ত খান, ওজন গড় প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় দুই থেকে তিনগুণ বেশি।

আরও পড়ুন- সুস্মিতা সেনের হার্ট অ্যাটাক! কেন চরম ‘ফিট’ মানুষও আক্রান্ত হচ্ছেন হৃদরোগে?

সাধারণত, স্থূলতায় আক্রান্তদের দেহের অতিরিক্ত চর্বির একটি অংশ অগ্ন্যাশয়, লিভার এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলির চারপাশে জমে যায়। এটিই ভিসারাল ফ্যাট যা রক্তকে দূষিত করে, প্রদাহ সৃষ্টি করে এবং এই কারণেই স্থূলতা উচ্চ রক্তচাপ, টাইপ ২ ডায়াবেটিস এবং হার্ট অ্যাটাকের মতো স্বাস্থ্য সমস্যার কারণ। কিন্তু সুমো কুস্তিগীররা সাধারণত এই উপসর্গগুলিতে ভোগেন না। সুমো কুস্তিগীরদের বেশিরভাগ চর্বি ত্বকের নীচে জমে। তাদের ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রাও স্বাভাবিক, কোলেস্টেরলও সীমার মধ্যেই। হৃদরোগ, হার্ট অ্যাটাক এবং স্ট্রোক সুমোদের বিপদে ফেলে না।

ব্যায়াম অ্যাডিপোনেক্টিন নামক হরমোন ক্ষরণ বাড়ায়। অ্যাডিপোনেক্টিন রক্ত ​​প্রবাহ থেকে গ্লুকোজ এবং চর্বির অণুগুলিকে সরায়, ভিসারাল ফ্যাটের পরিবর্তে চর্বি জমে ত্বকের নীচে। জাপানে সুমো প্রশিক্ষণ শুরু হয় ভোর ৫ টায় এবং প্রায় ৫ ঘণ্টা তা চলে। কিন্তু ব্যায়াম বন্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ফলও টের পাওয়া যায়। যখন সুমো কুস্তিগীররা অবসর নেন, তখন কার্ডিওভাসকুলার রোগের ঝুঁকির মুখে পড়েন তারা। অবসরপ্রাপ্ত কুস্তিগীররা গড় জাপানি নাগরিকের চেয়ে আনুমানিক ১০ বছর আগেই মারা যান।

অ্যারিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক গ্লেন গেসারের মতে, স্থূলতা মোটেও বিপাকীয় রোগের কারণ নয়। তবে এটি দুর্বল স্বাস্থ্যের লক্ষণ। বিপাকীয় কার্যকারিতা উন্নত করার জন্য স্থূলতা কমাতেই হবে এমন নয়। শরীরের ওজনের ৫-৭% পর্যন্ত কমালেই তা উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলতে পারে দেহের উপর। শরীরের অতিরিক্ত চর্বি এবং আরও নির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে ভিসারাল ফ্যাট শরীরকে বিপদে ফেলছে কিনা তা বোঝা যেতে পারে রক্ত পরীক্ষা থেকেই। অতিরিক্ত ওজন অনিবার্যভাবেই দেহের নানা জয়েন্ট বা গাঁটের স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করে, স্লিপ অ্যাপনিয়ার অন্যতম কারণ স্থূলতা।

More Articles