অন্তর্বাস ছাড়াই ক্লাবের জার্সি পরে আকর্ষণ করতেন যৌনকর্মীরাও!

Club Football: তারকা খেলোয়াড় দল বদল করলে কখনই সমর্থকরা সেটা ভালো চোখে দেখে না। দল বদল করা তো চাকরি পালটানো নয়!

কোপা

সবাই তাকে নাপোলিয়ঁ বলে ডাকত। উচ্চতায় বেশ খাটো ছিল কিনা! আবার ফরাসি সেনানায়কের মতোই নতুন নতুন জায়গা দখল করতেও বেজায় ভালোবাসত, যদিও বুঝতেই পারছেন, সবটাই খেলার মাঠে।

পায়ে বল পড়লে তার উচ্চতা নিজে থেকেই বেড়ে যেত, গোটা মাঠে তার দাপট থাকত নিরঙ্কুশ। আর সেই ফুটবল তো বল পায়ে এলিতেলির খেলা নয়, জীবনের জঙ্গমতা মূর্ত হয়ে উঠত তার খেলায়। সে যখন ব্যালে নর্তকের সুষমায় গোলের দিকে এগিয়ে যেত, সবুজ ঘাসের বুকে অ্যারাবাস্কের মতো দু'পায়ের মাঝে সমকৌণিক দূরত্বের ছবি খোদাই হয়ে যেত। কোচেরা তার খেলা দেখে বিস্ময়ে মাথার চুল ছিঁড়ত। কিন্তু খেলায় দক্ষিণ আমেরিকার ফুটবল শৈলী খুঁজে পেয়ে ফরাসি ফুটবল বিশেষজ্ঞরা তাকে ক্রমাগত সোপর্দ করত। তা সত্ত্বেও ’৫৮-র বিশ্বকাপে সাংবাদিকেরা কোপাকে উদীয়মান তারকার সম্মান দেয়। সেবছর ইওরোপের সেরা ফুটবলার নির্বাচিত হয়ে সে সোনার বুটও জিতে নেয়।

ফুটবল তাকে দারিদ্র থেকে রেহাই দিয়েছিল। তার শুরুটা হয়েছিল খনি শ্রমিকদের একটা দলে খেলে। জন্মসূত্রে সে পোলিশ অভিবাসী, ছেলেবেলাটা বাপের সঙ্গে উত্তর ফ্রান্সের ‘ন্যু’ কয়লাখনি অঞ্চলেই কাটিয়েছে। কয়লাখনিতে যেমন হয়, প্রতিরাতে সে খনিতে ঢুকে যেত আর সর্বাঙ্গে কালিঝুলি মেখে পরদিন দুপুরে মাটির তলা থেকে বেরিয়ে আসত।

আরও পড়ুন- পোলিওতে কাবু, দুই পা অসমান, বাঁকা মেরুদণ্ড নিয়েই ফুটবলের শ্রেষ্ঠ শিল্পী হয়েছিলেন গ্যারিঞ্চা

কারিসো

দু'হাতের তালুর চুম্বকে পঁচিশ বছর ধরে ক্রমাগত বল টেনে নিতে নিতে সে হয়ে উঠেছিল প্রতিপক্ষের ত্রাস। আমাদেয়ো কারিসোর কথা বলছি, দক্ষিণ আমেরিকার ফুটবল শৈলীতে যে নতুন একটা মাত্রা যোগ করেছিল। নিজের পেনাল্টি অঞ্চল ছেড়ে আক্রমণে চলে যাওয়ার মতো ঔদ্ধত্য সে-ই প্রথম দেখিয়েছিল। ঝুঁকি বলে ঝুঁকি! এই আরহেন্তিনীয় গোলকিপার বেশ কয়েকবার বিপক্ষের খেলোয়াড়কে কাটিয়েও এসেছে! কারিসোর আগে এমন পাগলামির কথা কেউ দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারত না। ধীরে ধীরে তার এই ঔদ্ধত্য অন্য অনেকের মধ্যে সঞ্চারিত হয়। তার দেশোয়ালি ভাই গাতি, কলম্বিয়ার ইগিতা (হিগুয়িতা) কিংবা প্যারাগুয়ের চিলাভার্ত (শিলাভার্ট)- সবাই কায়মনোবাক্যে মনে করত গোলকিপার কেবল জ্যান্ত দেওয়াল নয় যে শুধু জালের সঙ্গে আঠার মতো জড়িয়ে থাকবে। তারা নিজেদের ইস্পাতের মাথাওয়ালা বল্লম হিসেবে প্রমাণ করতে মরিয়া ছিল।

একথা তো আর নতুন করে বলার কিছু নেই যে ভক্তরা বিপক্ষকে ঘৃণা আর অবজ্ঞায় ডুবিয়ে দিতে পারলে আর কিছু চায় না। কিন্তু আরহেন্তিনার যেকোনও ক্লাবের সমর্থকই এক বাক্যে কারিসোর শ্রেষ্ঠত্ব মেনে নেয়। এমনকী দু' একজন ছাড়া সবাই এটাও মেনে নেয় যে তার মতো এত গোল আর কোনও গোলকিপার ঠেকায়নি। যাইহোক, ১৯৫৮-র বিশ্বকাপে হেরে আরহেন্তিনার দল যখন লেজ গুটিয়ে সুইডেন থেকে দেশে ফিরল, তখন সবচেয়ে বেশি খিস্তি কারিসোই খেয়েছিল। বিশ্বকাপে আরহেন্তিনা ৬-১ গোলে চেকোশ্লোভাকিয়ার কাছে নাস্তানাবুদ হয়। এমন বিশ্বাসভঙ্গের জন্য গণপ্রায়শ্চিত্তের দাবি তো উঠবেই। সেদেশের সংবাদমাধ্যম তার এমন হাল করল যে মনে হচ্ছিল, আগেকার দিনে কাউকে শাস্তি দেবার জন্য যেমন কাঠের খাঁচায় দু'হাত ও মাথা আটকে রাখা হতো, কারিসোর জন্যও প্রকাশ্য রাজপথে একই বন্দোবস্ত হচ্ছে। স্পষ্ট টের পাওয়া যাচ্ছিল, ক্রদ্ধ জনতার চাপাস্বরের হিসহিসানি। এই গণক্ষোভের আগুনে কারিসো জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে যায়। বহুকাল পড়ে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে কারিসো সখেদে বলেছিল, "আমি সারাজীবনে যত গোল ঠেকিয়েছি তার কিছুই ভালো মনে পড়ে না, কিন্তু বিশ্বকাপে চেকোশ্লোভাকিয়া আমাকে যে ছ'টা গোল মেরেছিল সেগুলো স্পষ্ট মনে আছে।"

আরও পড়ুন- “জয় অথবা মৃত্যু”! বিশ্বকাপ ফাইনালের আগে ফুটবলারদের টেলিগ্রাম করলেন মুসোলিনি 

জার্সির আবেগ

উরুগুয়ের বিখ্যাত লেখক পাকো এহ্‌পিনোলা চিরকাল ফুটবলের নামে নাক সিঁটকেছেন। কিন্তু ১৯৬০-এর গ্রীষ্মের এক বিকেলে তিনি কিছু একটা শুনবেন বলে যখন রেডিওর নবটা ঘোরাচ্ছিলেন তখন কী মনে হতে স্থানীয় ধ্রুপদি লড়াইয়ের ধারাবিবরণী শুনলেন। পেনারল সেদিন ৪-০ গোলে নাসিওনালের কাছে নাস্তানাবুদ হয়েছিল।

রাত নামতে পাকো এতটাই অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়লেন যে একা একটা ঘরে বসে খেলেন। তিনি নিজের বিষাদ অন্যের মধ্যে সঞ্চারিত করতে চাইছিলেন না। কিন্তু এত বিষাদ এল কোত্থেকে? পাকোর ধারণা ছিল কোনও একটা নির্দিষ্ট কারণে নয় বরং এই মরজগতের স্বাভাবিক অবসাদই তাঁকে গ্রাস করেছে। কিন্তু অতর্কিতে এই ভাবনাটাও তাঁর মাথায় খেলে গেল, পেনারল হেরে গেল বলে নয় তো? উনি যে পেনারলের ভক্ত এতদিন সেটা জানতেনই না!

উরুগুয়ের কতজন খেলা-পাগল মানুষ সেদিন পাকোর মতো বিষণ্ণ ছিল? অন্যদিকে আনন্দে লাফাচ্ছিলই বা কতজন? পাকোর এই আত্মোপলব্ধিকে বিলম্বিত বোধোদয় বলাই যায়। নইলে উরুগুয়েতে জন্মালে প্রথম দিন থেকেই সবাই পেনারল কিংবা নাসিওনালের ভক্ত হয়ে যায়। কথায় কথায় লোকে বলে ‘আমি পেনারল’ অথবা ‘আমি নাসিওনাল’। গত শতাব্দীর শুরু থেকে এমনটাই চলে আসছে। এমন জনশ্রুতিও আছে যে, তখনকার দিনের পেশাদার প্রেমিকারা মন্তেভেদিয়োর বেশ্যাপাড়ায় নিজেদের খুপরি ঘরের সামনের দাওয়ায় কোনও অন্তর্বাস ছাড়াই পেনারল কিংবা নাসিওনালের জার্সি পরে বসে খদ্দের টানত।

অন্ধভক্তরা তো শুধু নিজের দল জিতলেই খুশি হয় না, তারা চায় শত্রুপক্ষের ক্রমাগত হার। ১৯৯৩ সালে মন্তেভেদিয়োর এক দৈনিকের তরফে অল্পবয়সীদের মধ্যে একটা সমীক্ষা চালানো হয়। তারা সারা সপ্তাহ বুকে আগুন পুষে রাখে আর রোববারে স্টেডিয়ামে গিয়ে নাসিওনালের হয়ে গলা ফাটায়। ওই অল্পবয়সীদের ঝাঁক থেকে একজন তো স্পষ্ট বলে দিয়েছিল, "পেনারলের জার্সি দেখলেই আমার গা গুলোয়। আমি চাই হতচ্ছাড়ারা সব ম্যাচে হারুক। বিদেশের কোনও ক্লাবের সঙ্গে খেললেও আমি ওদের সমর্থন করি না। হারুক ব্যাটারা।"

এভাবেই ফুটবল-পাগল শহরগুলো বিভাজিত হয়ে যায়। আরহেন্তিনার বিখ্যাত ক্লাব নিউওয়েল যেমন, রোসারিও শহরের অর্ধেক নাগরিকের হৃদয়ের মালিকানা তারা নিয়ে রেখেছে। ১৯৮৮-তে কোপা ক্লাব কাপে উরুগুয়ের নাসিওনাল তাদের হারিয়ে দিল। তাদের চির প্রতিদ্বন্দ্বী রোসারিও সেন্ট্রাল ক্লাবের সমর্থকরা সেদিন দলে দলে রাস্তায় নেমে বিদেশি ক্লাবের কাছে নিউওয়েলের হার উদযাপন করে।

যদ্দূর মনে পড়ে, আরহেন্তিনীয় সাংবাদিক ওসভালদো সোরিআনো আমাকে বুয়েনস আইরেসের বোকা জুনিয়র্স ক্লাবের এক ভক্তের মৃত্যুর গল্প শুনিয়েছিল। ওই লোকটি সারাজীবন শত্রু দল রিভার প্লেটকে ঘৃণা করে গেছে। কিন্তু মৃত্যুশয্যায় শুয়ে সে শেষ ইচ্ছে হিসেবে জানাল, মৃত্যুর পর তার দেহটা যেন রিভার প্লেটের পতাকায় মুড়ে দেওয়া হয়। এভাবেই সে নাকি শেষ নিঃশ্বাস নেওয়ার আগে ‘ওদের অন্তত একজন’কে নিকেশ করে যাবে।

আরও পড়ুন- এক হাতে রিভলবার, অন্য হাতে চিঠি! মাঝমাঠেই নিজেকে শেষ করে দিয়েছিলেন ফুটবলার

সমর্থকরা যদি কোনও ক্লাবের কেনা গোলাম হতে পারে, তাহলে খেলোয়াড়দের ক্লাবের প্রতি আনুগত্য থাকবে না কেন? তারকা খেলোয়াড় দল বদল করলে কখনই সমর্থকরা সেটা ভালো চোখে দেখে না। দল বদল করা তো চাকরি পালটানো নয়! যদিও খেলোয়াড়দের দিক থেকে দেখলে এটাই তাদের পেশা এবং পায়ের জোরেই তাদের রুটিরুজি জোটে। আধুনিক ফুটবলে তাই একটা জার্সির প্রতি আনুগত্য দেখিয়ে সারাজীবন খেলে যাওয়ার ভাবনাটা ভীষণই হাস্যকর। কিন্তু সমর্থকরা আজও দল বদলে অন্য দলে যাওয়াটাকে অপরাধ জ্ঞান করে এবং স্বাভাবিক কারণেই দলবদলুদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চায়। ১৯৮৯-এ ব্রাজ়িলের বেবেতো যখন ফ্ল্যামেঙ্গো ছেড়ে ভাস্কো দা গামায় গেল তখন ফ্ল্যামেঙ্গোর অনেক সমর্থক ভাস্কোর ম্যাচের দিন মাঠে যেত স্রেফ বিশ্বাসঘাতককে টিটকিরি মারতে; বেচারা বেবেতো তখন বর্ষার অবিরল বৃষ্টির মতো হুমকি শুনছে। অন্যদিকে আঘাতে আঘাতে জর্জরিত হয়ে হিউ দে জেনেইরোর ফুটবলও তার কাছে ক্রমশ আতঙ্কের কারণ হয়ে উঠছিল। চোট সারিয়ে মাঠে ফিরে ফের চোট পাচ্ছিল। ব্যাপারটা যখন ক্রমশ ঘোরালো হয়ে উঠছে, সে সোজা হিস্পানি দেশে পালাল। বছর কয়েক আগে আরহেন্তিনার অনেককালের তারকা খেলোয়াড় রেসিং ফুটবল ক্লাবের রোবের্তো পারফুমো দল বদলে চলে গেল রিভার প্লেটে। ফুটবলের ইতিহাসে ওর চেয়ে বেশি সময় ধরে এবং বেশি জোরে প্যাঁক খেতে আর কাউকে দেখা যায়নি। পারফুমো নিজেই পরে বলেছিল, "ওরা আমাকে কতটা ভালোবাসে সেটা আজ বুঝতে পারছি।"

পুরনো স্মৃতির জাবর কাটতে অভ্যস্ত সমর্থকরা খেলোয়াড়দের লাভক্ষতির এইসব চুলচেরা হিসেব বুঝতে চায় না। তারা বোঝে না ইদানীংকালে ক্লাবগুলো সব আড়ম্বরের কারখানা হয়ে উঠেছে। ব্যাবসা ভালো না চললে কোম্পানি এতদিন যাদের সম্পদ বলে বিবেচনা করত তাদের কয়েকজনের নামের পাশে লাল কালির দাগ পড়ে। তাদের তখন কোম্পানির স্বার্থেই বলি দেওয়া হয়। বুয়েনস আইরেসে সান লোরেনসো স্টেডিয়ামের ধ্বংসাবশেষের উপর তো এখন তৈরি হয়েছে অতিকায় কারিফো সুপারমার্কেট। ১৯৮৩-র মাঝে যখন স্টেডিয়াম ভাঙা হলো তখন বহু সমর্থক কাঁদতে কাঁদতে মুঠোভরে স্মৃতির গম্বুজের অবশেষ কুড়িয়ে বাড়ি নিয়ে গিয়েছিল।

ক্লাবের নামই ভক্তদের একমেবাদ্বিতীয়ম পরিচিতি পত্র। কখনও হয়তো দলের জার্সি, দলের জন্য তৈরি করা সুর, নিশান, অনুভবের তলদেশ থেকে অভিব্যক্তি খুঁজে আনে, যা হয়তো খেলার মাঠ থেকেই সংগৃহীত। কাতালোনিয়ার অধিবাসীদের কাছে বার্সেলোনা যেমন নিছক একটা ক্লাব নয়, বরং মাদ্রিদের অশুভ ক্ষমতাকেন্দ্রের বিরুদ্ধে তাদের দীর্ঘ সংগ্রামের প্রতীক। তারপর ধরুন, ১৯১৯ থেকে আজ পর্যন্ত আতলেতিক বিলবাও কোনওদিন কোনও বিদেশি বা অন্য প্রদেশেরও কাউকে দলে নেয়নি। বিলবাও বাস্কদের গড়, তারা বাস্ক খেলোয়াড় ছাড়া আর কাউকে নেয় না। স্বৈরাচারী ফ্রাঙ্কোর দীর্ঘ জমানায় অন্তত দু'টি স্টেডিয়ামে, বার্সেলোনার কাম্প নৌ আর বিলবাওয়ের সান মামেস- জাতীয়তাবাদী বিদ্রোহীদের অভয়ারণ্য। সেখানে কাতালান আর বাস্করা মাতৃভাষায় গান গেয়ে, সোল্লাসে চিৎকার করে খোলা হাওয়ায় তাদের বাতিল হয়ে যাওয়া জাতীয় পতাকা দোলাত। পুলিশের লাঠির গুঁতোয় যেমন বাস্ক জাতির আবেগ জাগ্রত হয়ে উঠেছিল, ঠিক তেমনই ফুটবল স্টেডিয়ামেও বাস্করা স্বাজাত্যাভিমানের আবেগে ভেসে যেতে থাকে। পারকিনসন্সে ভুগে ভুগে ফ্রাঙ্কো মারা যাওয়ার ঠিক এক বছরের মাথায় বিলবাও আর রিয়াল সোসিয়াদের খেলোয়াড়রাও নিজেদের পতাকা নিয়ে মাঠে ঢুকতে শুরু করে।

য়ুগোশ্লাভিয়ার টুকরো টুকরো হয়ে যাবার লড়াইয়ের সময়ও যুদ্ধক্ষেত্রে যাওয়ার আগেই খেলার মাঠে তিক্ততার উত্তাপ বোঝা গিয়েছিল। সার্ব আর ক্রোটদের মধ্যেকার প্রাচীন ঘৃণা ছড়িয়ে পড়ছিল বেলগ্রেড আর জ়াগ্রেব শহরের ক্লাবগুলোর খেলার সময়। ভক্তরা আবেগতপ্ত গলায় ইতিহাস-পুরাণ ঢুঁড়ে বের করে আনা গান সুরে-তালে নাগাড়ে গাইতে থাকে, পতাকা দুলিয়ে নিজেদের জাতিগত পরিচিতির জানান দেয়, সেগুলোই হয়ে উঠেছিল যুদ্ধে তাদের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার।

পুশকাশের গোল

১৯৬১ সালের কথা বলছি। রিয়াল মাদ্রিদ ঘরের মাঠে খেলছিল মাদ্রিদ আতলেতিকোর বিরুদ্ধে।

খেলা শুরু হয়েছে-কি-হয়নি, সামান্য সময়ের মধ্যেই ফেরেন্স পুশকাশ জোড়া গোল করল। সেই যেমন জ়িজ়িনো ১৯৫০-এর বিশ্বকাপে করেছিল। রিয়াল মাদ্রিদের স্ট্রাইকার হাঙ্গেরির পুশকাশ বক্সের ঠিক সামনে একটা ফ্রি-কিক পেল এবং নিখুঁতভাবে বলটা জালে জড়িয়ে দিল। পুশকাশ যখন গোলের আনন্দে দু'হাত তুলে উচ্ছ্বসিত হয়ে দর্শকদের দিকে দৌড় দেবে, ঠিক তখনই রেফারি বেআক্কেলের মতো সামনে এসে জানিয়ে দিল, "দুঃখিত ফেরেন্স আমি এটাকে বৈধ গোল বলতে পারছি না।"

ফলে পুশকাশ ফের ফ্রি-কিক নিল। আগেরবারের মতোই বাঁ-পায়ের শট, বল আগেরবার হাওয়ায় যে রাস্তায় গিয়েছিল এবারও তেমনই গেল। আগেরবার খেলোয়াড়দের তৈরি করা দেওয়ালে যারা যারা ছিল এবারও তারাই দাঁড়াল। গোলার মতো শট সেবার যেমন তাদের মাথার উপর দিয়ে গিয়েছিল এবারও তেমনই গেল। শেষে আরহেন্তিনীয় গোলকিপার মাদিনাবাইতিয়াকে এড়িয়ে আগেরবারের মতোই বাঁ-দিকের কোণায় গিয়ে জালে জড়াল। মাদিনাবাইতিয়া এবারও আগেরবারের মতো গোল ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এসেছিল, ফলে এবারও বলে আঙুল ছোঁয়াতে পারেনি।

আরও পড়ুন- উড়ন্ত গোল করতে করতেই মারাত্মক সংঘর্ষ, বাইসাইকেল কিক কেড়েছিল ফুটবলারের প্রাণ

সানফিলিপোর গোল

প্রিয় এদোয়ার্দো,

কথাটা তোমাকে না বলা পর্যন্ত শান্তি পাচ্ছি না। গতকাল আমি কারিফোর সুপারমার্কেটে গিয়েছিলাম। তোমার মনে আছে নিশ্চয় ওখানেই আগে আমাদের সান লোরেনসো ক্লাবের স্টেডিয়ামটা ছিল। কাল সুপারমার্কেটে গিয়েই আমার ছেলেবেলার নায়ক হোসে সানফিলিপোর সঙ্গে দেখা। সানফিলিপোর কথা তোমার মনে আছে তো? পরপর চারবার মরসুমের সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়েছিল। কাল সুপারমার্কেটে চাকা-লাগানো মালবওয়া ঠেলাগুলোর ভিড়ে আমি আর সানফিলিপো বেশ খানিকটা সময় একসঙ্গে হেঁটে কাটালাম। চারিদিকে তখন নানারকম খাবারের পাত্র, পানীয়ের ক্যান, হরেক সসেজ আর চিজ় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। যখন পয়সা মিটিয়ে বাইরে বেরুতে যাচ্ছি তখন হঠাৎ সানফিলিপো দু'বাহু প্রসারিত করে বলল। "ঠিক এইখানেই, বুঝলে, বোকা জুনিয়র্সের বিরুদ্ধে একটা ম্যাচে ওদের গোলকিপার রোমাকে একটা হাফ ভলিতে দাবড়ে দিয়েছিলাম।" এক গৃহবধূ নিজের ঠেলা ভর্তি করে দুনিয়ার স্টেক, তরি-তরকারি, পানীয়ের ক্যান নিয়ে এগুচ্ছিল। সানফিলিপো সেই মহিলার ঠিক আগে দাঁড়িয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে আমাকে বলল, "ফুটবলের ইতিহাসে ওটাই কিন্তু দ্রুততম গোল।"

তারপর মনে হলো, ও যেন মনঃসংযোগ করছে। বুঝি আমরা একটা কর্নার কিকের জন্য অপেক্ষা করছি। কিছুক্ষণ পর ফের আমাকে বলল, "সেন্টার হাফে যে বাচ্চাটা সেদিন খেলছিল তাকে বলেছিলাম, 'খেলা শুরু হওয়ার পর একটুও সময় নষ্ট না করে বক্সের মধ্যে আমাকে বলটা পাঠাবি। ঘাবড়াস না। আমি এমন কিছু করব না যাতে তোকে অস্বস্তিতে পড়তে হয়’। ব্যাপারটা ভেবে নতুন ছেলেটা একটু দুশ্চিন্তায় পড়েছিল, ও বোধহয় ভাবছিল যে বলটা লম্বা করে পাঠিয়ে দেওয়ার পর যদি আমি সেখানে পৌঁছতে না পারি তবে তো কেলোর কীর্তি হবে! ছোকরার নামটা মনে পড়েছে বুঝলে, কাপাদেভিয়া।" মেয়োনিজ়ের পাত্রগুলোর দিকে তাকিয়ে সানফিলিপো চেঁচিয়ে বলল, "বলটা কিন্তু চমৎকার বাড়িয়েছিল!" আশপাশের লোকজন নিশ্চিত আমাদের তারকাটা ভাবছিল। "বলটা এসে পড়েছিল এক হাফব্যাকের উপর। আমি প্রথমে একটু বেকুবই হয়ে গিয়েছিলাম, কিন্তু বল মাটিতে পড়ে একটু পেছনের দিকে গড়িয়ে আসে, ওই দেখো ওইখানে, আরে ওই যে, চালের বস্তাটা দেখতে পাচ্ছ না? ওইখানেই বলটা পেলাম।" সে লম্বা তাকের নীচের দিকে আঙুল তুলে দেখাচ্ছিল। তারপর কথা নেই বার্তা নেই হঠাৎ নীল সুট আর চকচকে চামড়ার জুতো পরে খরগোশের মতো দৌড় শুরু করল। "আমি বলটাকে ইচ্ছে করেই মাটিতে পড়তে দিলাম, আর মাটিতে পড়ার পরই বেদম জোরে শটটা নিয়েছিলাম।" এই বলে সে প্রবল গতিতে বাঁ পা চালাল। দোকানের দরজা দিয়ে যারা বেরুচ্ছিল সবাই ঘাড় ঘুরিয়ে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করছিল। তিরিশ বছর আগের একটা গোল যেন আবার নতুন করে করল, আমরা হাঁ করে তাকিয়ে দেখলাম বলটা ওই টঙের দিকে ব্যাটারি-রেজারের তাকের কাছে গিয়ে জালে জড়িয়ে গেল। সানফিলিপো স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে দু'হাত তুলে আনন্দ করছিল। দোকানের ক্রেতারা, দরজায় যে মেয়েগুলো বিল দেখে বাইরে যেতে দেয়, সবাই প্রবল হাততালি দিতে থাকল। আর আমি তো তখন কেঁদেই ফেলেছি। ‘এল নেনে’, আমাদের খুদে সানফিলিপো, সেই ১৯৬২ সালের গোলটা ফের করে দেখাল। কেন বলো তো? আমার মনে হয় আমি ছোটো থেকে ওর ভক্ত তো, সেজন্য আমাকে দেখাবে বলেই কাণ্ডটা ঘটাল!

ওসভালদো সোরিআনো

More Articles