মহালয়ার অর্থেই বাস মহামায়ার! কেন পালন করা হয় তর্পণের এই রীতি
মহালয়া শব্দটি ভেঙে দেখলে দেখা যায়, 'মহ' কথাটির অর্থ 'প্রেত' অর্থাৎ এবং আলয় কথাটির অর্থ 'আশ্রয়' (গৃহ)।
"ওরে আলয়ে আজ মহালয়া
মা এসেছে ঘর
তোরা উলু দে রে শঙ্খ বাজা
প্রদীপ তুলে ধর"
পুরাণ থেকে মহাভারত, মহালয়া ঘিরে বর্ণিত আছে নানান কাহিনি। মহালয়া পিতৃপুরুষদের উদ্দেশ্যে তর্পণ করার দিন অর্থাৎ এই দিন জল দান করার রীতি আছে। যেহেতু পিতৃপুরুষদের স্মরণ করার দিন, সেই যুক্তিতেই অনেকে মনে করেন এই দিন আসলে শোক পালনের দিন। অন্য মত অনুসারে, এই দিন থেকে দেবীপক্ষের সূচনা অর্থাৎ সব অশুভ শক্তির বিনাশের সূত্রপাত। তাই মহালয়া আদতে শুভ দিন।
যাই হোক, মহালয়া এসে গেলেই দুর্গাপুজোর দিন গোনা শুরু। কিন্তু মহালয়ার গুরুত্ব লুকিয়ে রয়েছে এর চেয়েও বড় একটি বিষয়ের অন্দরে, যা অনেকেরই অজানা। ত্রেতা যুগে শ্রীরামচন্দ্র অকালে দেবীকে আরাধনা করেছিলেন লঙ্কা জয় করে সীতা উদ্ধারের জন্য। দেবী দুর্গার আসল আরাধনা হয় বসন্তকালে এবং একেই আমরা বাসন্তী পুজো বলি। রামচন্দ্র অকালে-অসময়ে পুজো করেছিলেন বলে এই শরতের পুজোকে দেবীর অকালবোধন বলা হয়। সনাতন ধর্মে আছে, শুভ কাজ করতে গেলে যেমন বিবাহ, উপনয়ন, অন্নপ্রাশন ইত্যাদি করবার আগে প্রয়াত পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে কর-অঞ্জলি প্রদান করা হয় যাকে বলা হয় 'তর্পণ' করা। এই তর্পণ কথাটির অর্থ হল খুশি করা। শ্রীরামচন্দ্র লঙ্কা জয় করার আগে দেবী দুর্গাকে মর্তে আবাহন করেছিলেন। তখন তিনি পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে তিল-জল দ্বারা অঞ্জলি প্রদান করেছিলেন। সনাতন ধর্ম অনুযায়ী, এই দিন প্রয়াত ও আত্মাদের পৃথিবীতে সমাবেশ ঘটে। সমাবেশকে বলা হয় 'মহালয়'। মহালয় কথাটি থেকেই মহালয়া। পূর্বপুরুষদের তর্পণাদির জন্য একটি বিশেষ দিন এই মহালয়া। হিন্দুদের বিশ্বাস অনুযায়ী, যেহেতু পিতৃপক্ষে প্রেতকর্ম অর্থাৎ শ্রাদ্ধ,তর্পণ ইত্যাদি মৃত্যু সংক্রান্ত আচরণ অনুষ্ঠান পালিত হয়, সেহেতু এই দিনটি শুভ কার্যের জন্য প্রশস্ত নয়।
আরও পড়ুন- নেই দুর্গাপুজোর কোনও সম্পর্ক, মহালয়াতেই কেন তবে পিতৃতর্পণের ঢল
পুরাণ অনুযায়ী, জীবিত ব্যক্তির পূর্বে তিন পুরুষ পর্যন্ত পিতৃলোকে বসবাস করেন। এই লোক স্বর্গ ও মর্ত্যের মাঝামাঝি স্থানে অবস্থান করে। পিতৃলোকের শাসক হচ্ছে মৃত্যুর দেবতা যমরাজ। তিনি সদ্য মৃত ব্যক্তির আত্মাকে মর্ত্য থেকে পিতৃলোকে নিয়ে যান। পরবর্তী প্রজন্মের একজনের মৃত্যু হলে পূর্ববর্তী প্রজন্মের একজন পিতৃলোক ছেড়ে স্বর্গে গমন করেন এবং পরমাত্মায় অর্থাৎ ঈশ্বরের চরণে ঠাঁই পান। এই কারণে কেবলমাত্র জীবিত ব্যক্তির পূর্ববর্তী তিন প্রজন্মেরই শ্রাদ্ধানুষ্ঠান হয়ে থাকে।
সূর্য কন্যা রাশিতে প্রবেশ করলে পিতৃপক্ষ সূচিত হয়। এই সময় পূর্বপুরুষগণ পিতৃলোক পরিত্যাগ করে তাঁদের উত্তর পুরুষদের গৃহে অবস্থান করেন।পুনরায় যখন সূর্য বৃশ্চিক রাশিতে প্রবেশ করে তখন তাঁরা পিতৃলোকে ফিরে যান। পিতৃগণের অবস্থানের প্রথম পক্ষে হিন্দুদের পিতৃ পুরুষেদের উদ্দেশ্যে তর্পণাদি করতে হয়। মহাভারতের কাহিনিতে বর্ণিত আছে প্রসিদ্ধদাতা কর্ণের মৃত্যু হলে তাঁর আত্মা স্বর্গে গমন করে এবং তাঁকে স্বর্ণ ও রত্ন খাদ্য হিসেবে প্রদান করা হয়। কর্ণ ইন্দ্রকে (মতান্তরে যমরাজকে) এর কারণ জিজ্ঞাসা করলে ইন্দ্র জানান, কর্ণ সারা জীবন স্বর্ণই দান করেছেন, তিনি পিতৃগণের উদ্দেশ্যে কোনওদিন খাদ্য প্রদান করেননি, তাই স্বর্গে তাঁকে খাদ্য হিসেবে স্বর্ণই প্রদান করা হয়েছে। কর্ণ জানান, তিনি যেহেতু তাঁর পিতৃগণের সম্পর্কে অবহিত ছিলেন না, তাই তিনি কখনও খাদ্য প্রদান করেননি। এই কারণে কর্ণকে ১৬ দিনের জন্য মর্তলোকে গিয়ে পৃথিবীর পুরুষদের উদ্দেশ্যে অন্ন ও জল প্রদান করার অনুমতি দেওয়া হয়। এই পক্ষই পিতৃপক্ষ নামে পরিচিত।
মহালয় পক্ষের ১৫ টি তিথির নাম হলো-প্রতিপদ, দ্বিতীয়া, তৃতীয়া, চতুর্থী,পঞ্চমী, ষষ্ঠী, সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী,দশমী,একাদশী, দ্বাদশী, চতুর্দশী ও অমাবস্যা। হিন্দু বিশ্বাস অনুযায়ী, যে ব্যক্তি তর্পণে ইচ্ছুক হন, তাঁকে তাঁর পিতার মৃত্যুর তিথিতে তর্পণ করতে হয়। কোনও কোনও পরিবারে দেখা যায় পিতৃপক্ষে ভাগবত পুরাণ, ভাগবত গীতা ও শ্রী শ্রী চণ্ডীপাঠ করা হয়। অনেকে পূর্বপুরুষদের মঙ্গল কামনায় ব্রাহ্মণদের 'দান-দক্ষিণা' করেন।
আরও পড়ুন- কায়েত কণ্ঠে চণ্ডীপাঠে গোঁড়া হিন্দুদের আপত্তি, তবু অমর হয়ে রইলেন বীরেন ভদ্র
মহালয়া শব্দটির অর্থ মহান যে আলয় বা আশ্রয়। 'মহালয়' শব্দটিকে স্ত্রীলিঙ্গবাচক শব্দ হিসেবে ব্যবহার করা হয়, কারণ এই দিনই পিতৃপক্ষের অবসান হয় এবং অমাবস্যার অন্ধকার দূর হয়ে আলোকময় দেবীপক্ষের শুভারম্ভ হয়। দেবী দুর্গা মহামায়াই হলেন সেই মহান আলয় বা আশ্রয়।
"যে-বান্ধবা বান্ধবা বা যেন্যজন্মনি বান্ধবা যেযাং,ন মাতা,না পিতা,ন বন্ধু"
অর্থাৎ "যারা বন্ধু নন অথবা আমার বন্ধু ও যারা জন্ম জন্মান্তরে আমার আত্মীয় বন্ধু ছিলেন তাঁরা সকলেই আজ আমার অঞ্জলি গ্রহণ করুন।"
এটিই হল তিল তর্পণের মূল বক্তব্য। এই দিন পিতৃপুরুষেরা আমাদের আশীর্বাদ করেন। এছাড়াও এই দিন দেবী দুর্গার বোধন অর্থাৎ 'জাগরণ' করা হয়। মহালয়ার পর দেবীপক্ষের অর্থাৎ শুক্লপক্ষের প্রতিপদে ঘট বসিয়ে শারদীয়া দুর্গাপুজোর সূচনা করা হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, শ্রাবণ মাস থেকে পৌষ মাস, এই ৬ মাস দক্ষিণায়ন অর্থাৎ দেবতাদের ঘুমের কাল তাই বোধন অবশ্যই প্রয়োজন। আরও বলা দরকার যে, মহালয়ার পর প্রতিপদে যে বোধন হয়, সেই সময়েও সংকল্প করে দুর্গাপুজো করা যায়। একে বলে 'প্রতিপদ কল্পারম্ভা'। তবে সাধারণত আমরা ষষ্ঠী থেকে পুজোর প্রধান কার্যক্রম শুরু হতে দেখি, যাকে বলা হয়, "ষষ্ঠাদিকল্পারম্ভা"। কিছু প্রাচীন বনেদি বাড়ি এবং মঠ-মন্দিরে প্রতিপদ কল্পারম্ভা থেকেই পুজো শুরু হয়। যদিও প্রতিপদ কল্পারম্ভা থেকে পুজোর শুরু হলেও, মূল আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয় ষষ্ঠী থেকে এবং সপ্তমীতে বিগ্রহ পুজো আরম্ভ হয়। প্রতিপদ থেকে শুধু ঘটে পুজো ও চণ্ডীপাঠ চলে।
মহালয়া শব্দটি ভেঙে দেখলে দেখা যায়, 'মহ' কথাটির অর্থ 'প্রেত' অর্থাৎ এবং আলয় কথাটির অর্থ 'আশ্রয়' (গৃহ)। সনাতন ধর্ম অনুযায়ী বিশ্বাস, ওইদিন পিতৃপুরুষদের মর্তে তাঁদের গৃহে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। শ্রী শ্রী চণ্ডীতে বর্ণিত আছে, মহালয় হচ্ছে পুজো ও উৎসবের আলয়। মহালয়ার দিন পিতৃপুরুষদের উদ্দেশ্যে তর্পণে অর্থাৎ জলদানে পিতৃপুরুষদের আশীর্বাদ পাওয়া যায়, সাংসারিক সুখ, সমৃদ্ধি এবং শান্তি প্রাপ্তি হয়।
যাই হোক, মহালয়ার দিনটিকে ঘিরে মানুষের বিশ্বাস এবং পিতৃপুরুষদের প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধার্ঘ্য প্রদানের পাশাপাশিই আকাশে বাতাসে আনন্দ খুশির দোলা দিয়ে যায়। মনে করিয়ে দেয় আর ক'টা দিনের অপেক্ষা, "মা আসছে"। বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গাপুজোর দিন গোনা শুরু হয় এই মহালয়ার দিন থেকেই।
তথ্যসূত্র-
https://www.sanbadekalavya.in> and https://www.hindudata.com