একা 'দাদা-বৌদি'-ই বদলে দিয়েছে সোদপুরের ছবি! নামজাদা রেস্তোরাঁর ঠিকানা এখন মফসসল
Sodepur Restaurants: তিন বছরে কোন কোন রেস্তোরাঁ খুলেছে সোদপুরে
আজ থেকে ঠিক তিন বছর আগের কথা। তখনও সোদপুর, শহরতলির ছোট্ট একটা জায়গা খাদ্যরসিকদের পীঠস্থান হয়ে ওঠেনি। উল্টে এলাকার মানুষ একপ্রকার অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে খুঁজে বেড়াতেন ভালো কোনও রেস্তোরাঁ। দু'-একটা ভালো মানের স্থানীয় রেস্টুরেন্ট থাকলেও সেখানে খাবার খেতে খেতে এই অঞ্চলের মানুষের মুখেও চড়া পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু আজ সোদপুর এক ফুড হাবে পরিণত হয়েছে। এমন কোনও বড় রেস্তোরাঁ নেই, যার আউটলেট নেই সোদপুরে। হ্যাঁ, এখন নামজাদা সব রেস্তোরাঁই রয়েছে সোদপুরের কয়েক কিলোমিটারের মধ্যে। কিন্তু এর কারণ কী? গভীরে বোঝার চেষ্টা করা যাক ব্যাপারটা।
ফুড হাবে পরিণত হওয়ার সম্ভাব্য কারণ
২০১৯ সালে নামজাদা রেস্তোরাঁগুলির মধ্যে প্রথম 'দাদা বৌদি'-র রেস্তোরাঁরই প্রথম আউটলেট চালু হয় সোদপুরে। অন্যদিকে দেখতে গেলে বারাকপুরের বাইরে সোদপুরেই প্রথম 'দাদা বৌদি'-র রেস্তোরাঁ চালু হয়। ব্যস! এরপর থেকেই দ্রুত বদলে যায় এলাকার খোলনলচে। সুতরাং, একথা বলাই যায় যে, দাদা-বৌদির মতো খুব ছোট কিন্তু প্রসিদ্ধ এই ব্র্যান্ডই কান ধরে সোদপুরে টেনে আনল বাঘা বাঘা সব ফুড ব্র্যান্ডকে। এই বদলের সেকাল-একাল ধরতে ২০১৯ সালের আগে সোদপুরের রেস্তোরাঁর চিত্রটা একবারে ফিরে দেখা প্রয়োজন।
ছোট থেকে সোদপুর এলাকায় যাঁরা বেড়ে উঠেছেন, তাঁদের কাছে উৎসব পার্বণ বা বিশেষ কোনও দিনে রেস্তোরাঁ বলতে ছিল একমাত্র 'পেঙ্গুইন'। সাধ ও সাধ্যের মধ্যে বেশ ভালো মানের রকমারি পদ পরিবেশন করা হতো এই রেঁস্তোরায়। পরের দিকে সোদপুর এলাকাতেই একই নামে দু'-তিনটি শাখাও খুলেছিল এই রেস্তোরাঁ। এর মধ্যে একটি একবারে সোদপুর রেল স্টেশনের পাশেই, দ্বিতীয়টি রেল স্টেশনলাগোয়া মার্কেট চত্বরে। বিরিয়ানির জন্য ছিল ঢাকা বিরিয়ানি এবং রাস্তার পাশে হাজি বিরিয়ানির একাধিক দোকান। এগুলির মধ্যে কোনও কোনও দোকানে তো ট্যাঁকের কড়ি খরচ করেও বিশেষ ভালো মানের বিরিয়ানি পাওয়া যেত না।এরপর চালু হলো পাঞ্জাবি রেস্তোরাঁ। কিন্তু এটিও একেবারে স্থানীয় রেস্তোরাঁ। ফলে বলা যায়, সোদপুর এলাকায় ভালো রেস্তোরাঁর আকাল বহুকালের। যদিও এর মাঝে ডমিনোজ, ক্যাফে কফি ডে-র আউটলেট খুলে গিয়েছিল সোদপুরে। কিন্তু এরপরেও বাঙালির পেটপুরে সুস্বাদু খাবার খাওয়ার রেস্তোরাঁর অভাব থেকেই গিয়েছিল। ফলে ২০১৯ সালে যখন সোদপুরে দাদা বৌদি-র রেস্টুরেন্ট খুলেছিল, তখন ময়দান খানিক ফাঁকাই ছিল। আর এই দোকানের বিরিয়ানির সুখ্যাতি সম্পর্কে সোদপুরের মানুষ ভালোভাবেই অবগত ছিলেন। ফলে খদ্দের টানতে খুব কাঠখড় পোড়াতে হয়নি রেস্তোরাঁ কর্তৃপক্ষকে। মানুষের ভিড় উপচে পড়তে শুরু করে রেস্টুরেন্টের সামনে। তবে এ তো গেল দাদা-বৌদির বাজার ধরার কথা। কিন্তু এই বাজারেই পরবর্তী সময়ে ঢুকে পড়েছে আমিনিয়া, আরসালান, সাংহাইয়ের মতো বড় মাপের রেস্তোরাঁগুলি।
আরও পড়ুন: ‘দাদা-বৌদি’: বেড়ার দোকান থেকে আলিশান হোটেল, কোন মন্ত্রে লাখো মানুষের মন জয়
এর নেপথ্যে মূলত দু'টি কারণকে চিহ্নিত করা যেতে পারে। প্রথমটি নগরায়ন এবং দ্বিতীয়টি যোগাযোগ ব্যবস্থার সুবিধা। সোদপুরের বেশিরভাগই কলোনি এলাকা হিসেবেই পরিচিত। তবে সোদপুর বিটি রোড বরাবর চলতে থাকলে নগরায়নের ছাপ সুস্পষ্ট। শুধু সোদপুর নয়, আশপাশের এলাকাগুলির যে হারে নগরায়ন হয়েছে- তা চোখে পড়ার মতোই। কয়েকশো মিটারের দূরত্বে বিটি রোডজুড়ে একেবারে রাস্তার ওপরেই শেষ দশ বছরে তৈরি হয়েছে একাধিক বিলাসবহুল নামী-দামি বহুতল ফ্ল্যাট। ইতিমধ্যেই সেগুলিতে মানুষ থাকতেও শুরু করেছেন। ফলে এই এলাকায় বসবাসকারী মানুষের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যও আর আগের মাপকাঠিতে বিচার করার উপায় নেই। তবে এলাকার মানুষের বিক্রয়ক্ষমতা যে আগের তুলনায় কয়েক গুণ বেড়েছে, তার প্রমাণ হিসেবে বলা যায় বহু নাম করা ব্র্যান্ডের শোরুম উদ্বোধন। এই তালিকায় সোনার দোকান থেকে শুরু জামাকাপড়ের ব্র্যান্ড- সবই রয়েছে। ফলে খানিক ব্যবসায়িক তাগিদে বাজার ধরতেই ময়দানে নেমে পড়ে বড় রেস্তোরাঁগুলি। পাশাপাশি শহরের যোগাযোগ ব্যবস্থার সার্বিক পরিকাঠামোর উন্নয়নও পরোক্ষভাবে দায়ী এজন্য। কলকাতা মেট্রো রুটের সম্প্রসারণের ফলে সোদপুর প্রত্যক্ষ পথে না হলেও পরোক্ষভাবে জুড়ে গেছে শহর কলকাতার সঙ্গে। বরানগর-দক্ষিণেশ্বর মেট্রো চালু হয়ে যাওয়ায় কলকাতার একেবারে দক্ষিণ প্রান্তের মানুষেরও আজ সোদপুর পৌঁছতে তেমন ঝক্কি পোহাতে হয় না। বরানগর মেট্রো থেকে নেমে এক বাস বা অটোতে সরাসরি সোদপুর পৌঁছে যাওয়া সম্ভব। ফলে বিটি রোডের দু'পাশে পড়ে থাকা ফাঁকা জমিগুলির ভালোমতো সুযোগ নিয়েছে বড় রেস্তোরাঁ-মালিকরা। খুলে ফেলেছেন একের পর এক নামকরা রেস্তোরাঁর আউটলেট। আর রমরমিয়ে লোকও টানছে এগুলিতে।
শেষ তিন বছর সোদপুরে যে যে রেস্তোরাঁ খুলেছে তার তালিকা
• দাদা-বৌদি রেস্টুরেন্ট
• আমিনিয়া
• আরসালান
• করিমস (দিল্লি-বেসড)
• আউধ ১৫৯০
• রং দে বসন্তী ধাবা
• ওয়াও চায়না
• সাংহাই চাইনিজ রেস্টুরেন্ট
• চাউম্যান
• হাতারি
• কষে কষা
• কস্তুরী
• ভূতের রাজা দিল বর
• কেএফসি
• পিৎজা হাট
• ৬ বালিগঞ্জ প্লেস (টেক অ্যাওয়ে)
• আহুনা মুটাটা (চম্পারণ মিট)
• বারবিকিউ নেশন (শীঘ্রই চালু হবে)
সর্বসাকুল্যে প্রায় কুড়িটি নতুন এবং নামকরা রেস্তোরাঁ খুলেছে সোদপুরের কয়েকশো মিটারের দূরত্বে। খোদ কলকাতা শহরের বুকেও একই জায়গায় এতগুলি নামকরা রেস্তোরাঁ খুঁজে বের করা অসম্ভব। তাই পুজোতে আর অন্য কোথাও নয়, ভোজনরসিক বাঙালির জন্য পেটপুজোর একেবারে আদর্শ জায়গা সোদপুর।