"আমাকে খুন না করলে ওরা গোল পেতে পারবে না," যে ভাবে অঙ্ক মিলিয়ে দিলেন মার্টিনেজ

Emiliano Martinez Argentina: বিশ্বকাপের ফাইনালে আগে এই মার্টিনেজ বলেছিলেন, "এমবাপের ফুটবল জ্ঞানের ঘাটতি রয়েছে।"

আর্জেন্টিনা বিশ্ব ফুটবলের অতিমানব লিওনেল মেসির দল। তবে গত রাতে এই ধারণা ভেঙে দিয়েছেন আর্জেন্টিনার গোলরক্ষক এমিলিয়ানো মার্টিনেজ। একজন নয় বরং আর্জেন্টিনা অতি মানবদের দল, প্রমাণ হয়ে গিয়েছে গতকাল রাত্রে। দুর্দান্ত পারফরমেন্স লিওনেল মেসির। নিজের পঞ্চম বিশ্বকাপ খেলতে এসে ক্যারিয়ারের সেরাটা খেলেছেন তিনি। ৩৬ বছর বয়সেও বুঝিয়ে দিয়েছেন, তিনি এখনও ফুরিয়ে যাননি। তবে এর আগের বিশ্বকাপে কখনও নকআউটে গোল করতে পারেননি তিনি। এবারের প্রতিটি নক আউটে গোল করেছেন।

এ বছরের ফুটবল আসরের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সাতটি গোল এসেছে কিংবদন্তি মেসির পা থেকেই। গোল্ডেন বুটের বিজেতা যতই কিলিয়ান এমবাপে হন না কেন, টাইব্রেকারে বিশ্বকাপ জিতে 'গোট' বিতর্ক থামিয়ে দিয়েছেন মেসি। তবে শুধুমাত্র মেসির পারফরমেন্সের জোরেই যে বিশ্বকাপ জিতেছে আর্জেন্টিনা, এরকম বলা ভুল। এই বিশ্বকাপে সমান দাপট দেখিয়েছে আর্জেন্টিনার প্রত্যেক খেলোয়াড়। আর ফাইনালে নিজের সেরাটা দিয়ে আলবিসেলেস্তেদের ভরসা হয়ে উঠেছেন মাটিনেজ।

আর্জেন্টিনার জার্সিতে তাঁর ক্যারিয়ার মাত্র ২৫টি ম্যাচের এবং তাতেই কিংবদন্তি হয়ে উঠেছেন তিনি। ২০২১ সালে অভিষেক হওয়া মার্টিনেজ আর্জেন্টিনার ইতিহাসের সেরা গোলরক্ষক। মাত্র ২৫ টি ম্যাচের ক্যারিয়ারে জাতীয় দলের হয়ে তিনটি শিরোপা জিতে নিয়েছেন তিনি। মার্টিনেজ ব্রাজিলের মাটিতে ব্রাজিলকে হারিয়ে কোপা আমেরিকা জয়ের ক্ষেত্রে রেখেছিলেন বড় ভূমিকা। সেই কোপা আমেরিকাতে টাইব্রেকারে দলকে জয় এনে দিয়েছিলেন তিনি। এরপর চলতি বছর ইতালির বিপক্ষে ফিনালিসীমা জিতেছেন তিনি। আর এবারে আর্জেন্টিনাকে জিতিয়েছেন বিশ্বকাপ।

২০১৮ বিশ্বকাপে রাশিয়ায় গিয়েছিলেন কেবলমাত্র একজন দর্শকের ভূমিকায়। সেবার শেষ ষোলোয় ফ্রান্সের কাছে হেরে ছিটকে যেতে হয়েছিল আর্জেন্টিনাকে। সেদিন গ্যালারিতে বসে নিজের ভাইকে মার্টিনেজ বলেছিলেন, "একদিন আমাকে আর্জেন্টিনার বারের নিচে দেখতে পাবে।" আর সেই দিনটাই সত্যি হলো।

আরও পড়ুন- এটাই শেষ নয়, পরের বিশ্বকাপও খেলবেন বিশ্বজয়ী মেসি?

আর্জেন্টিনার ক্লাব ইন্ডিপেনডিয়েন্টেতে যখন খেলেছিলেন মার্টিনেজ, তখন তাঁর নাম দেওয়া হয়েছিল ডিবু। আসলে মার্টিনেজকে আর্জেন্টিনার একটি সোপ অপেরা, 'মি ফ্যামিলিয়া এস উন ডিবুজো'-এর একটি চরিত্রের মতো দেখাত। বলা বাহুল্য, এই সোপ অপেরা আর্জেন্টিনার প্রথম লাইভ অ্যাকশন অ্যানিমেটেড শো ছিল। কিন্তু এমির ফুটবলের শীর্ষ পর্যায়ে ওঠার কাহিনি এতটা সহজ ছিল না। মাত্র ১৭ বছর বয়সে আর্জেন্টিনা ছেড়ে ইংল্যান্ডে ফুটবল খেলতে আসেন মার্টিনেজ। সই করেন আর্সেনালের হয়ে। কিন্তু তাঁকে নিচুস্তরের লিগের ক্লাবগুলিতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। মেসি যখন একটি মরশুমে ৯৩ গোলের ইতিহাস তৈরি করেছিলেন, এমি মার্টিনেজ তখন ইংল্যান্ডের নিম্ন স্তরের লিগে অক্সফোর্ড ইউনাইটেড খেলতেন।

ধীরে ধীরে নিজের প্রতিভা এবং অসাধারণ চরিত্রের মাধ্যমে সবার নজরে চলে আসেন মার্টিনেজ। একেবারে বড় সুযোগ আসে ২০২০ সালে। সেই সময় আর্সেনালের গোলকিপার বেন্ড লেনো চোট পেয়ে গোটা মরশুম থেকে ছিটকে যান। আর গানার্সদের হয়ে গোলপোস্ট রক্ষণের দায়িত্ব পান মার্টিনেজ। তবে আর্সেনালে বেশিদিন থাকা হয়নি তাঁর। আর্সেনালের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হওয়ার কারণে তিনি সই করেন ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের আরেকটি দল অ্যাস্টন ভিলাতে। সেখানেও ক্রমাগত ভালো পারফর্ম করতে শুরু করেন এমি মার্টিনেজ। আর সেখান থেকেই আর্জেন্টিনার কোচ স্কালোনির নজরে আসেন মার্টিনেজ।

সময় অত্যন্ত দ্রুত বদলে যায়। ২০১৮ সালে যে গোলকিপারকে চিনত না কেউ, সেই মার্টিনেজ ২০২২ সালে মেসির হাতের তুরুপের তাস। তাঁর ভাইকে বলা কথাগুলো মিলে গিয়েছে অক্ষরে অক্ষরে। গোটা আর্জেন্টিনা দেখেছে এতদিন তাঁর হাতেই সুরক্ষিত রয়েছে আর্জেন্টিনার গোল বক্স। আর্জেন্টিনার ডাকাবুকো গোলকিপার তিনি। ফাইনাল যখন টাইব্রেকারে এসে পৌঁছলো, তখন তিনি মেসির মসিহা। আর্জেন্টিনার সমস্ত ভরসার জায়গা তিনি। ফাইনালেও তিনি রক্ষাকর্তা। টাইব্রেকারে তাঁর ওই গ্লাভস থামিয়ে দিল কোমানের শট।

আরও পড়ুন- প্রথম ম্যাচে হেরেও বিশ্বজয়! কেন রূপকথাকেও হার মানাবে মেসিদের এই যাত্রা?

কোয়ার্টার ফাইনালে ম্যাচে নেদারল্যান্ডের বিপক্ষে জিতে সেমিফাইনালে এসেছিল আর্জেন্টিনা। প্রথমার্ধে ম্যাচে ২-০ গোলে এগিয়ে থাকলেও, পরবর্তীতে ২-২ গোলের সমতায় শেষ হয় ম্যাচ। ডাচদের কাম ব্যকের পর যখন স্বপ্নভঙ্গের আশঙ্কা, তখন মার্টিনেজ মেসিকে আশ্বস্ত করেছিলেন, "আমি তো আছি।" সত্যিই তিনি সেদিনের ম্যাচে অতিমানব হয়ে হাজির হয়েছিলেন এবং ফিরিয়ে দিয়েছিলেন দু'টি শট। শেষ পর্যন্ত ৪-৩ ব্যবধানে দলকে জয় এনে দিয়েছিলেন মার্টিনেজ।

আর এবারের ফাইনালে টাইব্রেকারে নিজের চাপ সামলানোর অসাধারণ দক্ষতা দেখিয়ে দিলেন আর্জেন্টিনার এই গোল রক্ষক। এই ম্যাচে ২-০ গোলে প্রথমার্ধে এগিয়ে গিয়েছিল আর্জেন্টিনা। দ্বিতীয়ার্ধে ২-২ করে দেন এমবাপে। অতিরিক্ত সময়ে মেসি গোল করলেও পেনাল্টিতে আবার গোল করে ফ্রান্স। ফলে ১২০ মিনিট খেলা শেষের পর ব্যবধান দাঁড়ায় ৩-৩। কিন্তু, টাইব্রেকারে ফ্রান্সের চারটে শটের দু'টি দুর্দান্ত দক্ষতায় ফিরিয়ে তিনি বুঝিয়ে দিলেন কেন তিনি বাজপাখি, কেন তিনি পেনাল্টি বিশেষজ্ঞ।

এই মার্টিনেজ একবার বলেছিলেন, মেসির জন্য তিনি জীবন দিয়ে দিতে পারেন। এই মার্টিনেজ ক্রোয়েশিয়া ম্যাচের বিরতির সময় সতীর্থদের অভয় দিয়ে বলেছিলেন, "তোমরা খেলে যাও, আমি পিছনে রয়েছি। আমাকে খুন না করলে ওরা গোল পেতে পারবে না।" বিশ্বকাপের ফাইনালে আগে এই মার্টিনেজ বলেছিলেন, "এমবাপের ফুটবল জ্ঞানের ঘাটতি রয়েছে।" যদিও আগুনে ঘৃতাহুতি দিয়েছিলেন এমবাপে নিজেই। তিনি বলেছিলেন, "দক্ষিণ আমেরিকার দলগুলি বিশ্বকাপে পৌঁছনোর মতো উঁচু মানের ফুটবল খেলে না। দক্ষিণ আমেরিকায় ফুটবল ইউরোপের মত অতটা উন্নত নয় এবং এই কারণেই গত কয়েকটি বিশ্বকাপে ইউরোপ জিতেছে।" শুধুমাত্র মাঠের বাইরে নয়, মাঠের ভিতরেও এমবাপেকে শিক্ষা দিতে চেয়েছিলেন তিনি। তবে এমবাপেকে শিক্ষা দেওয়া এত সহজ ছিল না। এমবাপে হয়তো তাঁর থেকে ভালই খেলতে জানেন ফুটবলটা। কিন্তু, টাইব্রেকারে চমক দিলেন এই মার্টিনেজ। হয়ে উঠলেন ফাইনালের নায়ক।

More Articles