এবার বাতিল জিনিস থেকে তৈরি প্লেনের জ্বালানি! কতটা কমবে পরিবেশ দূষণ?
অতি দ্রুত বিশ্বের প্লেন জ্বালানির জগতে বড় রকমের পরিবর্তন আনতে চলেছে এই জ্বালানি। বদল আসবে বর্জ্য নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রটিতেও।
জ্বালানি বর্তমান বিশ্বের একটি বড় সংকট। একদিকে যেমন খনিজের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার পৃথিবীর খনিজ ভাণ্ডারকে শেষ করে, অপর দিকে এই জ্বালানির ব্যবহারে যেসব ক্ষতিকর গ্যাস তৈরি হয়, তা বায়ুমণ্ডল তথা সমগ্র পরিবেশকেই অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেয়। গ্লোবাল ওয়ার্মিং বা পরিবেশ দূষণ নিয়ে আজ মানুষ চিন্তিত, পরিবেশ দিবসও উদযাপন করে তারা, কিন্তু এই উদযাপনেই সাধারণত চিন্তার মেয়াদ শেষ হয়ে আসে। বাস্তবে কাজ তেমন হয় না কিছুই। শেষ পর্যন্ত গ্রেটা থুনবার্গের মতো কিছু মানুষ নিজের ভবিষ্যতের চিন্তা না করে পৃথিবীর ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করতে এগিয়ে আসেন।
বৃহৎ উৎপাদন ও দূষণের ব্যাপারটা সাধারণ মানুষের হাতেও খুব একটা নেই। তাঁরা ব্যবহারিক ক্ষেত্রে কিছু বিরোধ তৈরি করতে পারেন, কিন্তু তাতে ব্যবস্থা বদলাবে না। ক্ষমতা যাঁদের হাতে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নিজের লাভের জন্য তাঁরা এই বদল চায় না। পৃথিবীতে পরিবহণ থেকে দূষণের মাত্রা বিপুল। সেই দূষণের একটা বড় অংশের জন্য দায়ী প্লেন। উড়োজাহাজ ওড়ার সময় প্রচুর পরিমাণে কার্বন ডাই-অক্সাইড তৈরি হয়। দীর্ঘদিন ধরে প্লেনের জ্বালানির বিকল্প খোঁজার চেষ্টা করে চলেছেন বিজ্ঞানীরা। কিছু বিকল্প আবিষ্কারও হয়েছে, কিন্তু তা এতটাই দামি যে, খুব কম এয়ারলাইন তাদের ব্যবহার করে, তাও অনিয়মিত। মধ্যপ্রাচ্যে আবু ধাবিতে প্রথম এমন জ্বালানি আবষ্কৃত হয়েছে, যার উৎপাদনে খরচ নেই তেমন।
আবু ধাবির ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট সেন্টার (তদবির) এটিহাড এয়ারওয়েজের সঙ্গে একটি জয়েন্ট প্রজেক্ট ডেভলপমেন্ট এগ্রিমেন্ট-এ (জেপিডিএ) সই করেছে। পৃথিবীর প্রথম ওয়েস্ট টু সাস্টেইনেবল এভিয়েশন ফুয়েল উৎপাদন করছে তারা। একটি গাছের থেকে এই তেল তৈরি করা হচ্ছে। এই গাছটি ৪০ লক্ষ টন মিউনিসিপাল সলিড ওয়েস্ট (এমএসডব্লিউ) অর্থাৎ বর্জ্যপদার্থ বা ময়লাকে প্লেনের জ্বালানিতে পরিণত করতে পারে বলে জানানো হয়েছে একটি প্রেস রিলিজে। এমিরেট নিউজ এজেন্সির মতে, এই গাছ থেকে উৎপন্ন জ্বালানি কার্বন ডাই-অক্সাইড কমাতে অনেকটাই সাহায্য করবে। ফলে আবু ধাবি আন্তর্জাতিক নাগরিক উড়ান সমিতির (আইসিএও) দ্বারা উড়ান বিভাগকে কার্বনহীন করার স্বীকৃতিও পেতে পারে।
আরও পড়ুন: পরিবেশ ধ্বংস করে কয়লাখনি, দেউচা-পাঁচামি ও সরকারি জেদ
এই গাছটি আবু ধাবির ৭৫ শতাংশ কঠিন বর্জ্যকে ব্যবহারযোগ্য করে পরিবেশ দূষণ কমাতে সাহায্য করবে। গাছটি জ্বালানির ফলে বায়ুমণ্ডলে মেশা কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ এক বছরে ১০ লক্ষ টন কমিয়ে ফেলার ক্ষমতা রাখে। প্রায় ২ লক্ষ গাড়ি এই পরিমাণ কার্বন ডাই-অক্সাইড তৈরি করে। ফলে ব্যক্তিগত যানবাহনের ওপরে চাপ খানিকটা কমবে বলেই আশা করা হচ্ছে।
‘দ্য সাস্টেনেবল বায়োএনার্জি রিসার্চ কনসর্টিয়াম’ নামের একটি সংস্থা এই জাতীয় জ্বালানি আবিষ্কার করে। কেবলমাত্র মরুভূমির বালি এবং সমুদ্রের জল ব্যবহার করে অতি কম খরচায় এই গাছ উৎপাদন সম্ভব। প্রতিটি গাছে প্রচুর পরিমাণে বীজ থাকে। এই বীজ পিষে ভেজিটেবল অয়েল প্রস্তুত করা হয়। এই তেলে এতখানি শক্তি থাকে, যে এর থেকে পরিষ্কার উড়ান-জ্বালানি তৈরি করা সম্ভব।
ড. সেলিম আল কাবি, তদবির-এর ডিরেক্টর জেনারেল-এর মতে “ময়লায় জমির পর জমি ঢেকে যাচ্ছে। এটা বর্তমান পৃথিবীর একটা বড় সমস্যা। ভূমিদূষণ তো হচ্ছেই, এর সঙ্গে জলদূষণ বা বায়ুদূষণও পরোক্ষভাবে জড়িত। ফলে এই চুক্তি নিয়ে আমরা আশাবাদী। তদবির বরাবরই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, কীভাবে এই বিপুল পরিমাণ কঠিন বর্জ্যকে জ্বালানি তৈরির কাজে ব্যবহার করা যায়, সেইসব প্রযুক্তির আবিষ্কারই আমাদের লক্ষ্য। বর্জ্য সমস্যা সমাধানে আশা করি আমরা সফল হব। আমরা এবং আমাদের সঙ্গীরা, সবাই মিলে একটা অসাধারণ বিশ্বমানের বর্জ্য নিয়ন্ত্রণের কার্যক্রম নিতে পেরেছি, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি পরিচ্ছন্ন সুন্দর পরিবেশ গড়ে তোলার উপায় খুঁজে পেয়েছি– এতে বেশ গর্ব হচ্ছে।”
মহম্মদ আল বুলুকি এটিহাডের চিফ অপারেটিং অফিসার। এ-বিষয়ে তাঁর বক্তব্য, “সত্যি সত্যিই যদি উড়ানের ক্ষেত্রে আমরা এই ধরনের স্থায়ী ব্যবস্থা করতে চাই, তবে আমাদের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত জ্বালানি। এই জ্বালানির চাহিদা অনুযায়ী তেমন উৎপাদনই নেই। এই চুক্তির ফলে, ৪ মিলিয়ন টনের বর্জ্য হয়ে যাবে ১৪০ মিলিয়ন গ্যালন এসএএফ। ফলে আমাদের বার্ষিক চাহিদার অনেকটাই এতে পূরণ হবে। আজ তদবির এবং এটিহাডের এই মিলিত প্রচেষ্টায় আবু ধাবিকে এসএএফ এবং সিনফুয়েল উৎপাদনের একটা কেন্দ্র গড়ে তোলার লক্ষ্যে একধাপ এগোলাম আমরা।”
ময়লা থেকে এই জ্বালানি উৎপাদন পদ্ধতি মধ্যপ্রাচ্যে আবু ধাবিকে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ করে তুলবে। শহরের ময়লা, বাণিজ্যিক এবং কলকারখানার ময়লাও ধীরে ধীরে প্লেনের জ্বালানি তৈরিতে ব্যবহার করবে আবু ধাবি। ফলে পৃথিবীর মানচিত্রে বৃহত্তর এসএএফ উৎপাদনকারী হিসেবে তা নিজের জায়গা তৈরি করে নেবে বলেই মনে করছেন অনেকে।
প্রস্তাবিত ডব্লিউটিএফ প্ল্যান্টটি অর্থাৎ বর্জ্য থেকে জ্বালানি উৎপাদনের কারখানা তদবির এবং এটিহাড- দু'জনের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় গঠিত হবে। জ্বালানি জোগান দেওয়ার কাজে তদবির, এবং তার ক্রেতা হিসেবে এটিহাড আরও দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতে আবদ্ধ হবে বলেই খবর। প্রাইভেট সেক্টরকেও আমন্ত্রণ করা হবে লগ্নির জন্য। নানা ধরনের চিন্তাভাবনা, প্রস্তাব, পরিচালনা সংক্রান্ত উপদেশ– সমস্তই গৃহীত হবে। আপাতত, আরবে এই গাছের চাষ হয়ে চলেছে। অত্যন্ত কম খরচে প্রচুর পরিমাণে বীজের জোগান রীতিমতো সফল। অতি দ্রুত বিশ্বের প্লেন জ্বালানির জগতে বড় রকমের পরিবর্তন আনতে চলেছে এই জ্বালানি। বদল আসবে বর্জ্য নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রটিতেও।