বন্দুকের নলের মুখে অসহায় সাংবাদিক! সাক্ষাৎ মৃত্যুর হাত থেকে ফিরিয়েছিলেন এই ফুটবলার

Last World Cup of Maradona: মারদোনা এবং গতির রাজা কানিহিয়াকে [ক্যানিজিয়া] ছাড়া আরহেন্তিনা ছিটকে পড়ল।

রিঙ্কনের গোল

১৯৯০-এর বিশ্বকাপের খেলা চলছিল। কলম্বিয়া সেদিন জার্মানির চেয়ে ঢের ভালো খেলেও ১-০ গোলে ম্যাচটা হারতে বসেছিল।

খেলার একেবারে শেষের মিনিটে মাঝমাঠে বল উড়ে এল জনৈক ঝাঁকড়াচুলো খেলোয়াড়ের মাথা লক্ষ্য করে, সামান্য ঝাঁকুনিতেই যার চুলে বিদ্যুৎতরঙ্গ খেলে যায়, সেই বালদেররামা [ভালদেররামা] বলের থেকে খানিকটা এগিয়ে ছিল, ফলে তাকে পেছনে ঘুরে জার্মানির গোলের দিকে পিঠ করে বলটা ধরতে হলো। বল পায়ে নিয়ে সে ঘুরল, শরীরটা সামান্য বাঁকিয়ে অপ্রয়োজনীয় তিন জার্মান খেলোয়াড়কে মাটিতে ফেলে দিয়ে বলটা রিঙ্কনের দিকে ঠেলল। এরপর শুরু হল তাদের নিজেদের মধ্যে পাস খেলা। বল একবার বালদেররামার কাছে যায়, তো পরমুহূর্তে রিঙ্কনের কাছে। এই রকম তুইমুঁই চলতে থাকল বেশ কিছুক্ষণ। ততক্ষণে রিঙ্কন জিরাফের মতো লম্বা পা বাড়িয়ে বেশ কয়েক গজ এগিয়ে গিয়ে জার্মান গোলকিপার ইগনারের মুখোমুখি হয়েছে। সেসময় রিঙ্কন আর ইগনার শুধু কিন্তু ইগনার গোটা গোলটা একেবারে ঢেকে রেখেছিল বললেও কম বলা হয়। রিঙ্কনও চালু জিনিস, শট তো সে মারলই না, বরং বলটাকে পায়ের পাতায় খেলিয়ে আদর করতে থাকল। শেষমেশ ইগনারের দু' পায়ের ফাঁক গলে গড়িয়ে গিয়ে বল জালে জড়াল।

হুগো স্যাঞ্চেজ়

১৯৯২-এ পা দিতেই য়ুগোস্লাভিয়া অনেকগুলো টুকরোয় ভেঙে গেল। যুদ্ধের উন্মাদনায় সহোদরকেও বিশ্বাস করতে ভুলে গেল মানুষ। নিহত ভ্রাতার ভাই-দোস্ত-ইয়ারকে যুদ্ধ শেখাল হৃদয়ে কঠিন হয়ে কোনও অনুশোচনা ছাড়াই খুন-ধর্ষণে লিপ্ত হতে। 

মেহিকোর দুই সাংবাদিক এপি ইবাররা এবং এরনান বেরা সারাজেভো যাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করছিল। বোমাবিধ্বস্ত, অবরুদ্ধ সারাজেভো তখন বিদেশি সংবাদমাধ্যমের জন্য নিষিদ্ধ এলাকা। ততদিনে অবরোধের ভ্রূকূটি এড়িয়ে রণাঙ্গনে প্রবেশ করা একাধিক দুঃসাহসী সাংবাদিকের প্রাণও গেছে। 

নগরীর অলিগলিতে তখন বিশৃঙ্খলা। সবাই সবাইকে সন্দেহের চোখে দেখে, সবাই সবার শত্রু। কে কার বিরুদ্ধে লড়ছে বোঝা শক্ত। পাগলাগারদের মতো কোলাহলপূর্ণ ট্রেঞ্চে দাঁড়িয়ে তারা কেন অন্যের বিরুদ্ধে লড়ছে তা-ও তাদের সক্কলের অজানা। চারদিকে ধোঁয়া, ধ্বংসস্তূপ আর বেওয়ারিশ লাশের সারি। হাতে মানচিত্র নিয়ে এপি আর এরনান গিয়ে পড়ল গোলন্দাজ বাহিনীর গোলাবর্ষণ আর মেশিনগানের ভলকে ভলকে উগরে দেওয়া বুলেটের সামনে। ড্রাইনা নদীর পাড়ে তারা একসময় মিলিটারির সামনে পড়ে গেল। মিলিটারি দুই সাংবাদিককে মাটিতে ফেলে দিয়ে বুকের মাঝখানটিতে বন্দুক তাক করে দাঁড়াল। বাহিনীর প্রধান হেঁড়ে গলায় তাদের কী জিগ্যেস করল কে জানে! তারাও মিনমিন করে কিছু একটা উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু অফিসার বন্দুক কাঁধে ঠেকিয়ে ট্রিগারের দিকে আঙুল নিয়ে গেল। বন্দুকের গুলি বেরনোর আগে একটা মৃদু আওয়াজ হলো, ক্লিক! এপি আর এরনান বুঝে গেল যদি স্বর্গ বলে সত্যিই কিছু থেকে থাকে তাহলে তার প্রার্থনা করতে করতেই এ মর্ত্যভূমি থেকে বিদায় নেওয়া ছাড়া তাদের গত্যন্তর নেই। 

তারপর হঠাৎ কী মনে হতে, ঘাসের ওপর শুয়েই তারা নিজেদের পাসপোর্ট বের করল। এক ঝলকে তাদের পাসপোর্ট দেখে অফিসারের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল! ‘মেক্সিকো’ অফিসার চেঁচিয়ে বলল, ‘হুগো  স্যাঞ্চেজ়!’

সঙ্গে সঙ্গে বন্দুক নামিয়ে সে দুই সাংবাদিককে বুকে জড়িয়ে ধরে।

হুগো স্যাঞ্চেজ় এমনিতেই মেহিকোর নানা সংকটের ‘খুল যা সিমসিম’। টিভির দৌলতে দুনিয়াজোড়া খ্যাতি তার। ছোটো পর্দায় মানুষ তার অসাধারণ এক একটা গোল আর তারপর হাতে ভর দিয়ে ডিগবাজি খাওয়ার মনোমুগ্ধকর দৃশ্য দেখেছে। ১৯৮৯-’৯০ মরসুমে রিয়াল মাদ্রিদের জার্সিতে সে মোট আটত্রিশবার গোলার মতো শটে বল জালে জড়িয়ে দিয়েছিল। তার আগে হিস্পানি ফুটবলের ইতিহাসে এক মরসুমে এতগুলো গোল আর কোনও বিদেশি খেলোয়াড় করেনি।

আরও পড়ুন-৬ গোল হজমের শাস্তি! ভক্তদের পাথরবৃষ্টিতে ছারখার হয়ে গিয়েছিল ফুটবলাররা…

উচ্চিংড়ে আর পিঁপড়ের কিস্‌সা

১৯৯২ সালে এগারোজন সুরেলা উচ্চিংড়ে ২-০ গোলে হারাল শ্রমজীবী পিঁপড়ের দলকে।

বস্তুত জার্মানি আর ডেনমার্ক ইওরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে মুখোমুখি হয়েছিল। জার্মান খেলোয়াড়রা কঠোর পরিশ্রম, পরিমিত আহার আর বেল্লেলাপ্না থেকে কয়েক যোজন দূরে নীরবে অনুশীলন করে নিজেদের শানিয়ে নিয়েছিল। কিন্তু দিনেমাররা সেদেশের লম্বা দিন জুড়ে বিয়ার খেয়ে, নারীর সঙ্গে রমণীয় সময় কাটিয়ে আর অকাতরে ঘুমিয়ে দিন কাটাচ্ছিল। আসলে ডেনমার্ক যোগ্যতা নির্ণায়ক ম্যাচে হেরে যাওয়ায় সে দলের ফুটবলাররা দেশে ফিরে ছুটি কাটাচ্ছিল। কিন্তু তখনই যুদ্ধ লাগায় আপৎকালীন পরিস্থিতিতে তাদের তলব করা হয় য়ুগোস্লাভিয়ার বদলি হিসেবে খেলার জন্য। তাদের অনুশীলনের সময় বা ইচ্ছে কোনওটাই ছিল না। শুধু তাই-ই নয়, ডেনমার্ক বাধ্য হলো সেদেশের সবচেয়ে বড় তারকা, ঠিকানা লেখা শট মারতে ওস্তাদ, হাসিখুশি, সদ্য বার্সেলোনার জার্সিতে ইওরোপিয়ান কাপ জেতা মিকেল লাউড্রপকে ছাড়াই খেলতে যেতে। ওদিকে জার্মান দলটা ছিল ম্যাথেউস-ক্লিন্সমান সহ বহু তারকায় ঠাসা। ম্যাচটা যেকোনও অবস্থাতেই জার্মানদের জেতা উচিত ছিল। কিন্তু তারা দিনেমারদের কাছে হারল। এগারোজন দিনেমারের সেদিন হারানোর কিছু ছিল না, তাই তারা এমন তূরীয় ফুটবল খেলেছিল যে বলার কথা নয়। মনে হচ্ছিল তারা বুঝি সমুদ্র সৈকতে অবকাশযাপন করতে এসেছে। 

খুলিট

১৯৯৩ সাল নাগাদ ইওরোপ জুড়ে বর্ণবিদ্বেষের ঢেউয়ে ফের জোয়ারের শক্তি অনুভব করা যাচ্ছিল। বর্ণবিদ্বেষ দুঃস্বপ্নের মতো ইওরোপের পিছু ছাড়ছিল না, সাদা-কালো দ্বন্দ্বের আঁশটে গন্ধ বেশ কিছু দিন ধরেই আর চাপা দেওয়া যাচ্ছিল না। হরেক আইনকানুন তৈরি হচ্ছিল পুরনো উপনিবেশগুলো থেকে আসা অভিবাসীদের বিরুদ্ধে, খুচখাচ হাতাহাতিও চলছিল। সাদা চামড়ার সদ্য-যুবকেরা নিজেদের বেকারত্বের জ্বালা মেটাতে অশ্বেতকায়দের দোষারোপ করছিল।

সেবছরই একটা ফরাসি দল প্রথমবার ইওরোপিয়ান কাপ জিতে নেয়। ফাইনালের চূড়ান্ত গোলটি করেছিল পশ্চিম আফ্রিকার আইভরি কোস্ট থেকে আসা কৃষ্ণাঙ্গ খেলোয়াড় বাসিল বোলি। ঘানায় জন্মানো আফ্রিকার আরেক সন্তান আবেদি পেলের কর্নার থেকে বাসিল বোলি নিখুঁত হেডে গোলটা করে। অন্যদিকে, সাদা চামড়ার মহত্ব ও স্বাভাবিক আধিপত্যের তত্ত্বে অন্ধ-আনুগত্য যাদের, তারাও অস্বীকার করতে পারত না যে সেসময় হল্যান্ডের সেরা খেলোয়াড় ছিল বর্ষীয়ান রুড খুলিট আর ফ্রাঙ্ক রাইকার্ড! দু'জনেই সুরিনাম থেকে আসা কৃষ্ণাঙ্গ পরিবারের সন্তান। কিংবা ধরুন, পর্তুগালের সর্বকালের সেরা খেলোয়াড় ছিল আফ্রিকায় জন্মানো ইউসেবিয়ো।

‘কালো টিউলিপ’ নামে বিখ্যাত রুড খুলিট চিরকালই বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল। ফুটবল খেলার সঙ্গে সঙ্গেই সে গলায় গিটার ঝুলিয়ে বর্ণবৈষম্য বিরোধী সমাবেশগুলোয় গান গাইতে হাজির হতো। ১৯৮৭ সালে খুলিট যখন ইওরোপের সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হলো, তখন ব্যালন ডি’ওর-টা সে নেলসন ম্যান্ডেলাকে উৎসর্গ করে, সেই ম্যান্ডেলা যিনি কৃষ্ণাঙ্গদের মানুষ বলে মনে করার অপরাধে জীবনের দীর্ঘ সময় কারান্তরালে কাটিয়েছেন।

খুলিটের একটা হাঁটুতে তিন-তিনবার অস্ত্রোপচার হয়েছিল। প্রত্যেকবারই সর্বজ্ঞরা নিদান দিত, এবার খুলিটের খেল খতম! কিন্তু ফুটবল খেলার তীব্র আকর্ষণে সে প্রত্যেকবারই স্বমহিমায় মাঠে ফিরেছিল, "যখন আমি মাঠের বাইরে থাকি, বলে পা ঠেকাতে পারি না, আমার নিজেকে কেমন সদ্যোজাত শিশুর মতো লাগে, যে তখনও মায়ের বুকে খাবার খুঁজতে শেখেনি।"

তার দ্রুতগামী, চতুর পা, গোল খুঁজে নিতে যার জুড়ি ছিল না এবং মাথায় এক পাহাড় ঘন কোঁকড়ানো চুল তাকে এমন এক উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিল যে হল্যান্ড কিংবা ইতালি যেখানে যত শক্তিশালী দলের বিরুদ্ধেই খেলুক না কেন, দর্শকদের মধ্যে তাকে নিয়ে আবেগ-উন্মাদনায় কখনও ঘাটতি হতো না। কিন্তু খুলিটের সঙ্গে কোচ-ম্যানেজারদের কোনওকালেই বিশেষ বনিবনা ছিল না। ওর স্বাভাবিক প্রবণতাই ছিল আদেশ-নির্দেশ অমান্য করা। শুধু তাই নয়, ওর একগুঁয়েমি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে যখন-তখন ফুটবলে বানিয়াদের মৌরসিপাট্টার বিরুদ্ধে মুখ খুলত। আর খুলবে নাই বা কেন, ওরাই তো খেলাটার মহিমা নষ্ট করে ফুটবলকে শেয়ারবাজারের তুচ্ছাতিতুচ্ছ পণ্যের সমগোত্রীয় করে তুলেছিল।

আরও পড়ুন-ফুটবলার না হোর্ডিং! জুতোর ফিতে বাঁধার নামে আসলে ব্র্যান্ড দেখাতেই চান খেলোয়াড়রা?

পিতৃহন্তা

১৯৯৩ সালের কথাই বলছি, দক্ষিণ গোলার্ধ থেকে শীত ততদিনে মুখ ফিরিয়েছে, কলম্বিয়ার জাতীয় দল বুয়েনস আইরেসে বিশ্বকাপের যোগ্যতা নির্ণায়ক একটা ম্যাচ খেলতে গেল। কলম্বিয়ার ফুটবলাররা মাঠে নামার সময় স্টেডিয়াম উপচে পড়া দর্শক তাদের বিদ্রূপ করতে যথেচ্ছ বাঁশির পোঁ ধরল, বক দেখাল, খিস্তিখাস্তাও চলল এন্তার। কিন্তু এখনও মনে আছে, খেলার শেষে যখন তারা মাঠ ছাড়ছিল গোটা গ্যালারি উঠে দাঁড়িয়ে তাদের অভিবাদন জানিয়েছিল।

আরহেন্তিনা সে ম্যাচে ৫-০ গোলে হারে। যথারীতি সব ব্যাটাকে ছেড়ে এবারও গোলকিপারকেই ধরা হয় এবং বেচারা গোলকিপার সারাজীবন সেই হারের ক্রুশকাঠ কাঁধে বয়ে গেছে। কিন্তু যেটা অভিনব, তা হলো অতিথি দলের জয় এর আগে কখনও এমনভাবে উদযাপিত হতে দেখা যায়নি। খেলা যত এগিয়েছে কলম্বিয়ার সমর্থকরা তাদের দলের অনন্য ফুটবল শৈলীকে উৎসাহ দিয়েছে, বল আর পায়ের সে এক রাজসূয় যজ্ঞ, সদাই পরিবর্তনশীল নয়নাভিরাম নৃত্যকলা যেন। আদতে শ্রমজীবী বর্ণসংকর, ‘খোকা’ নামে বিখ্যাত বালদেররামার অভিজাত খেলা দেখে রাজা-গজার বাচ্চারও হিংসে হতো। কৃষ্ণাঙ্গ খেলোয়াড়রা সেদিনের ফুটবল-উৎসবের তারকা হয়ে উঠেছিল; পেরেইয়া কিংবা ‘মালগাড়ি’ ভ্যালেন্সিয়াকে সূক্ষ্মদেহী কোনও আত্মাও কাটিয়ে যেতে পারছিল না। অ্যাস্প্রিয়ার অক্টোপাসের মতো প্যাঁচালো ট্যাকল সামলানোর ধকও সূক্ষ্মদেহী আত্মার ছিল না, আর রিঙ্কনের ওই গোলার মতো শট ঠেকাত কোন মাই-কা-লাল!

সেদিনের কলম্বিয়া দলের খেলোয়াড়দের গায়ের রং আর মাঠে তাদের আনন্দময় ফুটবল দেখে ব্রাজ়িলের সেরা সময়ের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। সে দেশের সংবাদমাধ্যম আরহেন্তিনা সংহারে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত তাদের জাতীয় দলের খেলোয়াড়দের ‘পিতৃহন্তা’ বলে চিহ্নিত করেছিল। পঞ্চাশ বছর আগে কলম্বিয়ার বোগোতা, মেদেলিন, কালি, এইসব শহরে ফুটবল প্রচলনের আদি পুরুষরা সব আরহেন্তিনীয় ছিল যে! কিন্তু জীবন মহাশয়ের নিজস্ব ভাবনার থই পাওয়া দুষ্কর। তাই সেদিন পেদেরনেরা, দি স্তেফানো, রোসি, রিয়াল, পোনতোনি, মোরেনোর সুসন্তানেরা কলম্বিয়ার হয়ে খেলেও বারবার ব্রাজ়িলের সোনালি দিনের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছিল।

জ়িকোর গোল

ফের ১৯৯৩-এর কথা বলছি। তোকিয়োতে এম্পারার্স কাপে কাশিমো খেলছিল তোহোকুর বিরুদ্ধে।

কাশিমোর তারকা খেলোয়াড় ব্রাজ়িলের জ়িকো সে-ম্যাচে জয়সূচক গোলটি করেছিল। জ়িকোর ফুটবল জীবনে সম্ভবত এটাই সেরা গোল। ডান দিক থেকে লম্বা একটা ক্রস এসেছিল। জ়িকো দাঁড়িয়েছিল অর্ধবৃত্তের মধ্যে। বল দেখে সে বেশ খানিকটা এগিয়ে গেল, কিন্তু সময়ের ভুলচুকে জ়িকো একটু আগেই লাফিয়েছিল। সে যখন বুঝল বলটা পিছনে রয়ে গেছে, তখন হাওয়ায় পুরোদস্তুর একটা ডিগবাজি খেল। তার মুখ যখন মাটির দিকে, সে ব্যাকহিল করে বলটা ঠেলে দিল গোলের দিকে। কিন্তু ব্যাকহিলটা কার্যত পিছনদিকে একটা গোলকিপারের মাথার ওপর দিয়ে ভলির মতো গেল।

একজন দৃষ্টিহীন মানুষ বলল, ‘আমাকে গোলটার কথা বল ভাই’।

আরও পড়ুন- “জয় অথবা মৃত্যু”! বিশ্বকাপ ফাইনালের আগে ফুটবলারদের টেলিগ্রাম করলেন মুসোলিনি

ছলে বলে কৌশলে

গোটা দেশ থেকে তখনও হিস্পানিরা ফ্রাঙ্কোর স্বৈরাচারের জ্বর ছাড়াতে পারেনি, রিয়াল মাদ্রিদের সভাপতি সান্তিয়াগো বেরনাবো চালিয়াতি করে ক্লাবের একটা লক্ষ্য স্থির করে দিল। সে ঘোষণা করল, "আমরা স্বদেশের জন্য খেলি। এই মহান দেশের জনগণকে আনন্দে রাখা ছাড়া আমাদের দ্বিতীয় কোনও লক্ষ্য নেই।"

ভিসেন্তে ক্যালদেরন ছিল আতলেতিকো মাদ্রিদে সান্তিয়াগো বেরনাবোর জুড়িদার। সে একধাপ এগিয়ে ফুটবলের নিজস্ব নেশায় ঘুমের বড়ির মতো মানুষকে আচ্ছন্ন করে রাখার মহৎ গুণের প্রশংসা করে বলে, "ফুটবলের সামাজিক গুরুত্ব অনেক মশাই! ফুটবলই মানুষকে যত মারাত্মক দুষ্কর্মের চিন্তা থেকে বিরত রাখে।"

১৯৯৩ এবং ১৯৯৪ সালে দুনিয়ার বহু ক্লাবের প্রধান পদাধিকারীদের বিরুদ্ধে নানারকম জালিয়াতি-প্রতারণার অভিযোগ ওঠে, বেশ কয়েকজনের সাজাও হয়। একথা বুঝতে খুব বেশি বুদ্ধিমান হওয়ার প্রয়োজন নেই যে, ফুটবল শুধু সামাজিক অস্থিরতা ঠেকাতে বা সামাজিক সংকটকে পাশ কাটিয়ে যেতেই জরুরি নয়; অঢেল সম্পত্তি লুকোতে বা আয়কর ফাঁকি দিতেও এর জুড়ি নেই।

সেসব দিন কবেই পেছনে ফেলে এসেছি আমরা, যখন ক্লাবগুলো ছিল সমর্থক আর খেলোয়াড়দের মিলনক্ষেত্র। এখন সেসব কথা তুললে মনে হবে প্রাগৈতিহাসিক যুগের কথা বলছি। সেইসময় ক্লাবের সভাপতি গলায় বেতের ঝুড়ি ঝুলিয়ে গ্যালারিতে লেবু ফিরি করত, মাঠে নেমে ঘাসের ওপর চুনের দাগ টানত। ক্লাব প্রধান হিসেবে সবচেয়ে বেশি উড়নচণ্ডেপনা করা বলতে সে হয়তো পাশের পাড়ার পানাশালায় গিয়ে জেতার আনন্দে একদিন সবার পানীয়ের দাম নিজে মিটিয়ে দিত। আর আজকের ক্লাবগুলো সব বড় বাণিজ্যিক সংস্থা, যারা ফুটবলার ভাড়া করে এনে নিজেদের ভাগ্য ফিরিয়ে নিতে পারে, খেলার নামে দর্শকের কাছে দেখার আরাম বেচে। সেইসঙ্গে তারা রাষ্ট্রকে দেদার ফাঁকি দেওয়ার কৌশল করায়ত্ত করে ফেলেছে, মানুষকে তো বোকা তো বানাচ্ছেই, শ্রম আইন থেকে শুরু করে যা যা আইনি রক্ষাকবচ এবং অধিকার আছে সব কিছুকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে চলেছে। আর দায় ঝেড়ে ফেলার ব্যাপারে তারা তুলনারহিত। দায় কাটানোর খেলায় অবিশ্যি পৃথিবীতে ফিফার চেয়ে বড় কোনও বহুজাতিক বাণিজ্যিক সংস্থা নেই। ফিফা পেশাদার ক্লাবগুলোর মাথা এবং তাদের নিজস্ব সর্বনেশে আইনকানুন আছে। আজব দেশে অ্যালিসের হরতনের রানির মতো ফিফার বেহুদা কানুন আগে নির্বাসনের দণ্ড ঘোষণা করে তারপর বিচার করতে বসে। ব্যাপারটা বুঝছেন না? আরে, গোটা ব্যাপারটা একটু থিতিয়ে এলে যাতে ভাবমূর্তি মেরামত করতে সুবিধে হয়, ফিফার গায়ে আঁচ না লাগে!

পেশাদার ফুটবল পরিচালিত হয় আইনের ফাঁকফোকর গলে। সে এক পবিত্র ভূখণ্ড যেখানে তারা দুনিয়ার যাবতীয় নিয়ম বাতিল করে শুধু নিজের আইন বলবৎ করতে পারে। কিন্তু ফুটবল কেনই বা এভাবে পরিচালিত হবে? আদালতের বিচারকরাও বড় বড় ক্লাবকে লাল কার্ড দেখাতে ডরায়। সেই সুযোগে ক্লাবগুলো আইনের বইপত্তর সেদ্ধ করে জনতার কোষাগার থেকে কোটি কোটি টাকা হাতায় এবং পরিচ্ছন্ন খেলার আইন মাঠে গড়াগড়ি খায়। বিচারকরাও বোঝে ক্লাবগুলোকে শক্ত হাতে ধরলে বিপদ আছে, তাদের কানের কাছে সবসময় তীব্র বাঁশির বিপদ সংকেত বেজে চলে। পেশাদার ফুটবলের গায়ে হাত দেওয়া অসম্ভব কারণ তার জনপ্রিয়তা আকাশছোঁয়া। "আরে বাবা, ক্লাবের সভাপতি তো আমাদের কথা ভেবেই আইন ভেঙেছে না কি?" এটা সমর্থকদের কথার কথা নয়, তারা দিব্যি বিশ্বাসও করে।

তবু কিছু বিবেকবন্দি বিচারক আছেন যাঁরা দায় এড়ানোর প্রাচীন বন্দোবস্ত অগ্রাহ্য করেন। এরই ফলশ্রুতিতে সাম্প্রতিককালে ক্লাবগুলোর টাকা-পয়সা নয়ছয়ের কসরতে কিছুটা হলেও আলো পড়ছে, বলাই বাহুল্য এতে দুনিয়ার নামকরা বেশ কয়েকটা ক্লাবও জড়িত। ইতালির পেরুজা ক্লাবের সভাপতির বিরুদ্ধে ১৯৯৩ সালে যখন রেফারিকে টাকা দিয়ে কিনে নেওয়ার অভিযোগ উঠল, তখন সে পালটা আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে বলেছিল, "পেশাদের ফুটবলের আশি শতাংশ দুর্নীতিগ্রস্ত।"

আরও পড়ুন- মায়ের মৃত্যু সামলে মাঠে হাজির রেফারি, স্টেডিয়াম থেকে ধেয়ে এল তীব্র খিস্তি…

বিশেষজ্ঞরা নিশ্চয় তার ঔদার্যকে সাধুবাদ জানাবেন। ইতালির প্রতিটি নামজাদা ক্লাব, উত্তর থেকে দক্ষিণে, মিলান থেকে তুরিন হয়ে নাপোলি কিংবা কালিয়ারি- সবাই জালিয়াতিতে জড়িয়ে আছে। কেউ বেশি কেউ কম। ওদের আয়ব্যয়ের জালিয়াতির হিসেব যদি দেখেন, তাহলে বুঝবেন নিজেদের মোট পুঁজির বহুগুণ ঋণ ওরা কেমন হজম করে বসে আছে। এমনকী সেসবের কোনও উল্লেখই পাবেন না। ক্লাবের হর্তাকর্তারা ঘুষ দেওয়া-নেওয়ার জন্য পর্যাপ্ত টাকা রাখে, বেনামে কোম্পানি খোলে, সুইস ব্যাঙ্কে টাকা লুকোয়। কর কিংবা সামাজিক সুরক্ষার জন্য ন্যূনতম ব্যয় না করে তারা কালো লেনেদেনে পয়সা খরচ করে। এমনকী খেলোয়াড়রা ক্লাবের জাবদা খাতায় যত টাকা নিচ্ছে বলে সই করে, তার থেকে ঢের কম টাকায় তাদের খেলতে হয়।

ফ্রান্সের ক্লাবগুলোর অবস্থাও তথৈবচ। বোরদোর বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে যেমন ক্লাবের টাকা হাতিয়ে ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির অভিযোগ আছে। অলিম্পিক দে মার্সেইয়ের পাণ্ডাটিকে তো হিঁচড়ে আদালতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল প্রতিপক্ষকে ঘুষ খাওয়ানোর অভিযোগে। ১৯৯৩ সালে ভ্যালোঁসিয়েঁর সঙ্গে ম্যাচের আগে যখন প্রকাশ্যে এল যে বিপক্ষের একাধিক খেলোয়াড়কে মার্সেইয়ের ভাগ্যবিধাতারা ঘুষ দিয়ে কিনে রেখেছে, তখন ফরাসি ফুটবলে অত যে ক্ষমতাধর ক্লাব মার্সেই, তাকেও ধাক্কিয়ে দ্বিতীয় বিভাগে পাঠিয়ে দেওয়া হলো। এমনকী এর আগে জেতা ফ্রান্স বা ইওরোপের সেরার শিরোপাও কেড়ে নেওয়া হয়। এই ঘটনাটি ক্রীড়া প্রশাসক হিসেবে ব্যবসাদার বেরনার তাপির ভবিষ্যতের বারোটা বাজিয়ে দেয়, তার রাজনৈতিক উচ্চাশাতেও জল ঢেলে দেয়। লোকটার একবছরের কারদণ্ড হয় এবং শেষমেশ তাকে দেউলিয়া ঘোষণা করা হয়।

ওই একই সময়ে পোল্যান্ডের সেরা ক্লাব লেগিয়ার হাত থেকে সেরার শিরোপা কেড়ে নেওয়া হয়, কেননা ওরা খানদুই ম্যাচ গড়াপেটা করেছিল। ইংল্যান্ডের টটেনহ্যাম হটস্পার যেমন একবার প্রকাশ্যে মুখ খুলেছিল, নটিংহ্যামের জঙ্গল থেকে একজন ফুটবলারকে নিজেদের দলে নেওয়ার জন্য তাদের বলা হয়েছিল টেবিলের তলা দিয়ে কালো টাকার কারবার করতে। ইংল্যান্ডেরই লুটন ক্লাব এখন কর ফাঁকির অভিযোগে জেরার মুখে পড়েছে।

ব্রাজ়িলেও ফুটবলের কেচ্ছা-কেলেঙ্কারির শেষ নেই। বোতাফোগো ক্লাবের সভাপতি অভিযোগ করেছে ব্রাজ়িলের পেশাদার ফুটবল লিগের কর্মকর্তারা নাকি ১৯৯৩ সালে সাত-সাতটা ম্যাচ গড়াপেটা করেছে। বিনিময়ে হর্তাকর্তারা জুয়ায় জেতার মতো রাতারাতি অনেক টাকা কামিয়ে নিয়েছে। সাও পাওলোতে একটা মামলা হয়েছিল, সেখানে দেখা যাচ্ছে স্থানীয় ফুটবল ফেডারেশনের এক মাতব্বর রাতারাতি কোটিপতি হয়ে গেছে। তার কয়েকটা বেনামি অ্যাকাউন্ট ঢুঁড়ে জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল যে তার টাকা-পয়সার এমন বাড়বাড়ন্তের পেছনে ফুটবল নামক মহৎ শিল্পে নিজের জীবন উৎসর্গ করা নয় বরং অন্য কোনও মহাবিদ্যার অবদান বেশি। ব্রাজ়িলের সাতকাহন লিখতে গেলে ঢাউস বই হয়ে যাবে, সেদেশের ফুটবল কনফেডারেশনের সভাপতি হিকার্দু তেইস্যেইরাকে স্বয়ং পেলে আদালতে টেনে নিয়ে গিয়েছিল টেলিভিশন স্বত্ব বিক্রিতে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগে। কিন্তু আভেলাঞ্জি তেইস্যাইরার নাম ফিফার বোর্ড সদস্য হিসেবে প্রস্তাব করেছিল। আর হ্যাঁ, আপনাদের জ্ঞাতার্থে জানাই, তেইস্যেইরা সম্পর্কে আভেলাঞ্জির জামাই।

এইসব ঘটনার দু' হাজার বছর আগে পবিত্র গ্রন্থ বাইবেলের পিতৃপুরুষরা যেসব চর্যাচর্যবিনিশ্চয় রচনা করেছিলেন তাতে আদি যুগের এক খ্রিস্টান দম্পতির কথা আছে। অ্যানানায়াস এবং তার স্ত্রী সাফাইরা একখণ্ড জমি বিক্রি করে, কিন্তু ঠিক কত টাকায় জমিটা বিক্রি হল সে বিষয়ে মিথ্যে বলে। এই মিথ্যেটুকু যেখানে ফাঁস হলো, ঈশ্বরের ইচ্ছেয় অ্যানানায়াস ও সাফাইরার সেই জায়গায়তেই মৃত্যু হয়।

ঈশ্বর নিজের শত ব্যস্ততার মধ্যেও ফুটবলের জন্য যদি সামান্য সময় বের করতে পারতেন, ভাবুন একবার, ক'টা ক্লাবের কর্মকর্তা এখনও বেঁচে থাকত। হা ঈশ্বর!

আরও পড়ুন- মহিলাদের যাতে অসম্মান না হয়, তাই সর্বাঙ্গ ঢাকা জামা পরে মাঠে নামতেন ফুটবলাররা!

১৯৯৪-এর বিশ্বকাপ

চ্যাপাসের লোকেরা প্রাচীন মায়া সভ্যতার নামে কাঁধে কাঁধ লাগিয়ে লড়ে যাচ্ছিল, সরকারি মেহিকোর ওপর প্রকৃত মেহিকো ক্রমশ ছেয়ে যাচ্ছিল, আর গোটা দুনিয়া অবাক হয়ে জ়াপাতিস্তাদের সহকারি সেনানায়ক ও মুখপাত্র কমান্দান্তে মারকোসের নির্মল ও ভালোবাসাভরা কথা অবাক হয়ে শুনছিল।

মানব হৃদয়ের অন্ধকার দিকে যার উপন্যাসের চলাচল, উরুগুয়ের ঔপন্যাসিক ওনেত্তি মারা গেলেন। ব্রাজ়িলের আয়ার্তো সেনা [আয়ারটন সেনা], ফর্মুলা ওয়ানের সর্বকালের অন্যতম সেরা চালককে ইওরোপের এক বিপজ্জনক ট্র্যাকে গাড়ি চালাতে বাধ্য করে সেরেফ খুন করে ফেলা হলো। এতকাল যাকে য়ুগোস্লাভিয়া নামে জানতাম, টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়া সেই ভূখণ্ডে সার্ব, ক্রোট আর মুসলমানরা একে অপরকে খুন করে চলেছিল। রুয়ান্ডাতেও একইরকম ঘটনা ঘটছিল, যদিও টেলিভিশনে জনজাতির কথা ফলাও করে বলা হচ্ছিল, মানুষের কথা নয়, যেন ধরেই নিয়েছে দাঙ্গা কেবল কালো মানুষই করে, বাকি সবাই ধোয়া তুলসীপাতা।

মার্কিন বাহিনীর রক্তাক্ত আর গা-জোয়ারি অনুপ্রবেশের চার বছর পর তোরিহোসের উত্তরসূরিরা পানামার নির্বাচনে জিতল। ক্ষুধা নিবারণে বুলেটের নিদান দেওয়া মার্কিন বাহিনী সোমালিয়া থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে নিল। দক্ষিণ আফ্রিকার মানুষ ম্যান্ডেলাকে ঢেলে ভোট দিল। কমিউনিস্ট নামের খোলস ছেড়ে বেরনো সোশালিস্টরা লিথুয়ানিয়া, ইউক্রেন, পোল্যান্ড এবং হাঙ্গেরির সংসদ নির্বাচনে জিতল। সবগুলো দেশই বুঝেছিল পুঁজিবাদের বেশ কিছু অস্বস্তিকর দিকও আছে। কিন্তু মস্কোর প্রগতি প্রকাশন, এককালে যারা মার্কস-লেনিনের রচনাবলি ছাপত, তারা আজ রিডার্স ডাইজেস্ট ছাপছে। মিয়ামির সর্বজ্ঞ মাতব্বররা বলে বেড়াচ্ছিল খুব শিগগিরই নাকি ফিদেল কাস্ত্রোর পতন অনিবার্য। আর সেরেফ কয়েক ঘণ্টার অপেক্ষা শুধু!

দুর্নীতির কেচ্ছায় ইতালির রাজনৈতিক দলগুলো ছারখার হয়ে যাচ্ছিল। সেই শূন্যস্থান পূরণ করছিল ভুঁইফোঁড় বার্লুসকোনি, যে গণতান্ত্রিক বৈচিত্র্যের নামে টেলিভিশনের স্বৈরতন্ত্র চালাত। বার্লুসকোনির নির্বাচনী প্রচারের জনপ্রিয়তম স্লোগানটি ফুটবল স্টেডিয়াম থেকেই ধার করা। ঠিক এই সময়েই পঞ্চদশ ফুটবল বিশ্বকাপ আয়োজিত হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। সেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যার প্রধান খেলা ফুটবল নয়, বেসবল।

মার্কিন প্রচারমাধ্যম অবিশ্যি ব্যপারটাকে খুব একটা পাত্তা দেয়নি, শুধু বলেছিল, "ফুটবল আমাদের ভবিষ্যৎ"। যদিও পাথর গলানো চড়া রোদের দুপুরেও স্টেডিয়ামের আসন খালি থাকেনি। ইওরোপের টেলি-সম্রাটদের খুশি করতে বড় ম্যাচগুলো ১৯৮৬-র মেহিকো বিশ্বকাপের মতোই ভরদুপুরে খেলা হয়েছিল।

ইওরোপের তেরোটা দেশ, আমেরিকার ছ'টা, আফ্রিকার তিনটে এবং দক্ষিণ কোরিয়া আর সৌদি আরব এই বিশ্বকাপে খেলেছিল। অমীমাংসিত ম্যাচের সংখ্যা কমাতে নিয়ম হয়েছিল জিতলে দু' পয়েন্ট নয়, তিন পয়েন্ট দেওয়া হবে। আর মাঠে মারামারি ঠেকাতে রেফারিরা এবার বাড়তি সতর্ক ছিল, টুর্নামেন্ট জুড়ে অকাতরে লাল-হলুদ কার্ড দেখানো হয়। এবারই প্রথম রেফারিরা ছাতার কাপড়ের পোশাক ছেড়ে রঙিন ফুরফুরে পোশাক পরল। ওদিকে গোলকিপার চোট পেলে যাতে তার জায়গায় কোনও গোলকিপার নামানো যায় সেজন্য প্রত্যেক দলকে তৃতীয় বদলি খেলোয়াড় ব্যবহারের সুযোগ দেওয়া হলো।

মারাদোনার এটাই ছিল শেষ বিশ্বকাপ, সুতরাং একটা উৎসবের আবহ ছিলই। যদিও সেটা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। দ্বিতীয় ম্যাচের পরেই ল্যাবরেটরিতে মূত্র পরীক্ষার নামে তাকে হারিয়ে দেওয়া হল। মারদোনা এবং গতির রাজা কানিহিয়াকে [ক্যানিজিয়া] ছাড়া আরহেন্তিনা ছিটকে পড়ল। গোটা টুর্নামেন্টে নাইজিরিয়া সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক ফুটবল খেলল। স্তোইচকোভের দল বুলগেরিয়া চতুর্থ স্থান পায়, তারা কোয়ার্টার ফাইনালে ভয়ংকর জার্মান দলকে সেরেফ দৌড়েই হারিয়ে দিয়েছিল। তৃতীয় স্থানে ছিল সুইডেন। ফাইনালে ইতালির সামনে ছিল ব্রাজ়িল। এত জঘন্য ফাইনাল খুব বেশি দেখা যায় না, এমন বড় মঞ্চে ফাইনাল হলো গোলশূন্য অমীমাংসিত। অবিশ্যি বিরক্ত হলেও দর্শকরা হাই তুলতে-তুলতে হোমারিয়ো [রোমারিয়ো] আর বাজ্জোর অসাধারণ ফুটবলের কিছু ঝলক দেখেছিল। পেনাল্টিতে ৩-২ গোলে জিতে ব্রাজ়িল বিশ্বজয়ীর শিরোপা পায়। ব্রাজ়িল জেতায় ফুটবলের ইতিহাসে একটা আশ্চর্য পরিসংখ্যান নির্মিত হলো, তারাই একমাত্র দেশ যারা সব ক'টা বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছে, চারবার বিশ্বকাপ জিতেছে, সবথেকে বেশি ম্যাচ জিতেছে, তার সব থেকে বেশি সংখ্যক গোলও করেছে।

’৯৪-এর বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ গোলদাতার তালিকায় ছ'টা করে গোল করে শীর্ষে ছিল বুলগেরিয়ার স্তোইচকোভ আর রাশিয়ার সালেঙ্কো। তার পরে পাঁচটা করে গোল করেছিল ব্রাজ়িলের হোমারিয়ো, ইতালির বাজ্জো, সুইডেনের আন্দারসন এবং জার্মানির ক্লিন্সমান।

More Articles