ছিঁচকে চুরি থেকে মুম্বই হামলা, নৃশংস ঘাতক কাসভকে যেভাবে সবক শিখিয়েছিল ভারত
26/11 Mumbai Attack ; মুম্বই হামলার কথা উঠলে সবার আগে মনে পড়বে তার নাম। নৃশংস হত্যালীলা চালানর পরও কাসভের ভাবভঙ্গি ছিল নির্বিকার...
এই মুখ হয়তো অনেকেরই চেনা। প্রতিদিন আসা-যাওয়ার পথে এরকম মুখগুলো আমরা দেখেছি। খুব সাধারণ, চুপচাপ, পাশের বাড়ির বা পাড়ার ছেলেটির মতো। অথচ সেই মুখের ওপারেই লেগে রয়েছে রকের দাগ। সেখানে রয়েছে চিৎকার, হাহাকার, গুলির শব্দ। রয়েছে হীরক রাজ্যের মগজধোলাই। আজ থেকে ঠিক ১৪ বছর আগে এমনই রক্তের বিভীষিকা দেখেছিল এই ভারত। বাণিজ্যনগরী মুম্বইয়ের সেই কালো দিনগুলোর কথা যেন আজও ফিরে আসে। তাজ হোটেলের দেওয়ালের প্রতিটা বুলেটের দাগ মনে করায় সেই ছেলেটির কথা। মহম্মদ আজমল আমির কাসভ। ২৬ নভেম্বর, ২০০৮-র সঙ্গে যে নামটি জড়িয়ে রয়েছে ওতপ্রোতভাবে। ২০১২ সালে কাসভের ফাঁসি হয় পুনের ইয়েরওয়াড়া সেন্ট্রাল জেলে। তখন তাঁর বয়স মাত্র ২৫। কিন্তু তাঁর আত্মা যেন এখনও ঘুরেফিরে আসে ২৬/১১-র দিনটিতে। মোমবাতির আলো আর শ্রদ্ধার্ঘ্যের ভেতরেই কেঁপে ওঠে আকখা মুম্বই।
কে ছিল এই কাসভ?
আরও পড়ুন : পুলওয়ামা বিস্ফোরণের মাস্টারমাইন্ড? ইমরানের কাঁটা নয়া পাক সেনাপ্রধানের আসল পরিচয় জানুন
পাকিস্তানের ওকারা জেলার ফরিদকোট গ্রামে সামান্য একটি বাড়িতে বসবাস আমির শাহবান কাসভ ও নুর ইলাহির। আমির শাহবানের ছোট্ট একটি দোকান, মুচমুচে স্ন্যাক্স জাতীয় খাবার বিক্রি করেন। তাঁর বড় ছেলে আফজল মুটে মজুরির কাজ করে। সেই দরিদ্র ঘরেই ১৯৮৭ সালে জন্ম হয় আজমল কাসভের। পড়াশোনা বেশি দূর এগোয়নি তার। বড় দাদার সঙ্গে মুটে মজুরির কাজেই লেগে পড়েছিল এক সময়। লাহোর থেকে ফরিদকোট, কাজ আর বাড়ি এই ছিল তার যাতায়াত। এরই মধ্যে ঈদের সময় নতুন জামাকাপড় না দেওয়ায় বাবার সঙ্গে ঝগড়া হয়ে যায় কাসভের। বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায় সে। এরপরই শুরু হয় খুচরো অপরাধে হাতেকড়ি। এক বন্ধুর সঙ্গে মিলে চলতে লাগল সেই চুরি-ডাকাতির কাজ। সেই অপরাধ এক সময় সশস্ত্র হয়ে ওঠে। অস্ত্র কেনার জন্য বন্ধুকে নিয়ে রাওয়ালপিণ্ডিও যায় কাসভ। আর এখান থেকেই শুরু হয় মুম্বই হামলার জঙ্গি আজমল কাসভের আসল গল্প।
আরও পড়ুন : ইমরানই প্রথম নন, যেভাবে বারবার প্রাণঘাতী হামলার শিকার হয়েছেন প্রাক্তন পাক প্রধানমন্ত্রীরা
রাওয়ালপিণ্ডিতে অস্ত্র কেনার সময়ই কাসভের সঙ্গে আলাপ হয় জামাত-উদ-দাওয়ার কয়েকজন প্রতিনিধির সঙ্গে। এই সংগঠনটি মূলত জঙ্গিগোষ্ঠী লস্কর-ই-তইবার একটি অংশ। নিজেদের ‘মতবাদ’ প্রচার করার জন্য লিফলেট বিলি করার সময়ই তাদের সামনে আসে কাসভ। তারপরই সে ওই দলের সঙ্গে নাম লেখায়। সোজা চলে যায় লস্কর-ই-তইবার বেস ক্যাম্পে, ‘জিহাদ’-এর প্রস্তুতিতে। মুজফফরবাদ, মাংলা ড্যাম, মানশেহরা সহ পাকিস্তানের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে শুরু হয় প্রশিক্ষণ। কমব্যাট, কম্যান্ডো, বন্দুক, বোমা চালানো, সাঁতার ও লঞ্চ, জাহাজ চালানোর ট্রেনিংয়ের পাশাপাশি শুরু হয় মগজধোলাই। ইসলামিক জিহাদের সঙ্গে কাসভের পরিচিতি শুরু হয়। মোট ২৪ জনের এই প্রশিক্ষণ শিবির থেকে ১০ জনকে বিশেষভাবে চিহ্নিত করা হয়। এই ১০ জনের দলে ঠাই হয় আজমল কাসভের। এমনভাবে ট্রেনিং দেওয়া হয় যে, জিহাদের জন্য মৃত্যুবরণেও এদের কোনও দুঃখ থাকে না। ‘ফিদায়ে’ হামলার জন্য এদেরকেই পাঠানো যায়। এই ১০ জনকে নিয়েই সংগঠিত হয় মুম্বই হামলার ‘মাস্টারপ্ল্যান’।
আরও পড়ুন : জঙ্গির আবেদন অগ্রাহ্য, বহাল মৃত্যুদণ্ডই! লালকেল্লা হামলার ত্রাস কে এই পাক জঙ্গি আরিফ?
এই ১০ জনের মধ্যে একমাত্র জীবিত ছিল আজমল কাসভ। গ্রেফতারির পর জিজ্ঞাসাবাদ, কথাবার্তায় নানাভাবে তার মনস্তত্ত্ব তদন্তকারী পুলিস অফিসারদের সামনে উঠে আসে। এই প্রসঙ্গে একজনের কথা উঠে আসে। তিনি কোনও পুলিস অফিসার নন, মুম্বইয়ের একজন নাগরিক, নাম দেবিকা রোটাওয়ান। ২০০৮ সালে তাঁর বয়স ছিল মাত্র ১০ বছর। মুম্বইয়ের বিখ্যাত ছত্রপতি শিবাজি টার্মিনাসে অজস্র মানুষের মধ্যে তিনিও ছিলেন। ২৬ নভেম্বর, ২০০৮ সালে সেই স্টেশনেই হামলা করে আজমল কাসভ। চোখে-মুখে পৈশাচিক হুংকার, হাতে কালান্তক একে-৪৭ রাইফেল। এই হামলায় কাসভের সঙ্গী ছিল ইসমাইল খান। আনুমানিক সাড়ে ৯টা নাগাদ দু’জনে ছত্রপতি শিবাজি টার্মিনাসে ঢুকে এলোপাথাড়ি গুলি চালাতে থাকে। সেই সময় বছর দশেকের দেবিকা সরাসরি কাসভের সামনে পড়ে যান। দেখতে পেয়েই সরাসরি বাচ্চাটির দিকে গুলি চালায় কাসভ। ঘটনাচক্রে সেই গুলি দেবিকার পায়ে লাগে, এবং তিনি বেঁচে যান।
আরও পড়ুন : রক্ত নেওয়া নয়, পাকিস্তানি জঙ্গিকে রক্ত দিয়ে ইতিহাসে নাম লেখাল ভারতীয় সেনা
বছর কয়েক আগে সেই বর্ণনার কথা মনে করতে গিয়ে বারবার শিউরে উঠছিলেন দেবিকা। একজন মানুষ, বয়স নিতান্তই কম, একটি বাচ্চা মেয়েকে গুলি করার সময় তার হাত একবারও কাঁপল না। সাড়ে ৯টা থেকে রাত ১০টা বেজে ৪৫ মিনিট, প্রায় এক ঘণ্টা ১৫ মিনিট ধরে চলেছিল গুলিবর্ষণ। কাসভ আর ইসমাইলের হামলায় সেখানে মারা যান ৫৮ জন নিরীহ মানুষ। আহত অন্তত ১০৪ জন। সিএসটি টার্মিনাসের ঘোষণাকারী বিষ্ণু দত্তরাম জেন্দে তড়িঘড়ি হামলার কথা মাইকে ঘোষণা না করলে হয়তো এই সংখ্যা আরও কয়েকগুণ বাড়তে পারত।
তবে কাসভের গুলির লড়াই তখনও শেষ হয়নি। ছত্রপতি টার্মিনাসে পুলিস আসার পর বাইরে বেরিয়ে ফের গুলিবর্ষণ শুরু করে কাসভরা। তাদের লক্ষ্য ছিল কামা হাসপাতালের রোগীরা। হাসপাতালের স্টাফরা সমস্ত কিছু বন্ধ করে দেওয়ায় সেই কাজটি আর সম্ভব হয়নি। ততক্ষণে ঘটনাস্থলে চলে আসে মুম্বইয়ের জঙ্গিদমন শাখার একটি দল। শুরু হয় গুলির লড়াই। কাসভ-ইসমাইলের গুলিতে মারা যান হেমন্ত কারকারে, বিজয় সালাসকার, অশোক কামটে সহ বেশ কয়েকজন উচ্চ পর্যায়ের অফিসার। তবে একসময় সাফল্য পায় পুলিস। গুলির লড়াইয়ে ইসমাইল নিহত হয়, সেইসঙ্গে কাসভও আহত হয়। পালানোর চেষ্টা করলে মুম্বই পুলিসের সাব-ইনস্পেক্টর টুকারাম ওম্বলে কাসভকে আটকে রাখে। সেইসময় তাঁর ওপরও ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি চালায় কাসভ। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। টুকারাম ওম্বলের সাহসিকতা ও আত্মবলিদানের বিনিময়ে গ্রেফতার করা হয় আজমল কাসভকে। তার বাকি নয়জন সঙ্গী মারা যায়।
আরও পড়ুন : রক্ত নেওয়া নয়, পাকিস্তানি জঙ্গিকে রক্ত দিয়ে ইতিহাসে নাম লেখাল ভারতীয় সেনা
এরপর ২০০৮ থেকে ২০১২- চারবছর ধরে চলে টানাপোড়েন। ২০০৮-এ মুম্বই পুলিসের ক্রাইম ব্রাঞ্চের প্রধান ছিলেন রমেশ মাহালে। গ্রেফতারির পর কাসভকে খুব কাছ থেকে দেখেন তিনি। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে অফিসার মাহালি কাসভের আশ্চর্য চরিত্রের কথা সামনে এনেছেন। গ্রেফতার করা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তার ফাঁসি হবে না – এই কথাটি বারবার কাসভের মুখ থেকে শুনেছেন তিনি। এতটাই বিশ্বাস ছিল তার। কাসভের যুক্তি ছিল, মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করার পরও আফজল গুরুকে ফাঁসি দেওয়া হয়নি। তাহলে তাকে কী করে দেবে! প্রতিটা কথা অত্যন্ত স্পষ্টভাবে, চোখে দৃঢ়তার ছাপ নিয়ে বলত কাসভ। মিথ্যে বলে বারবার পুলিসের চোখকে ধুলো দেওয়ার চেষ্টাও করে যাচ্ছিল সে। এমনকী আদালতে দাঁড়িয়ে এক সময় বলে উঠেছিল, ‘আমি অমিতাভ বচ্চনকে দেখতে পাকিস্তান থেকে ভারতে এসেছি।’ কিন্তু সেসব আদতে ঠাই পায়নি। সেই সময়ে ১০ বছরের ছোট্ট, আহত দেবিকা রোটাওয়ান আদালতে কাসভকে চিহ্নিত করেছিলেন। কাসভ যে পাকিস্তানের নাগরিক, সেটাও বারবার অস্বীকার করে পাকিস্তান। এমনকী এও বলা হয়, লস্কর-ই-তইবার জঙ্গিরা কাসভের জন্য তার পরিবারের কাছে মোটা অঙ্কের টাকাও দেয়। যা নিয়ে এখনও রয়েছে বিতর্ক। কাসভের বাবা শাহবান কাসভ বারবার টাকা নেওয়ার ব্যাপারটি অস্বীকার করেছেন। অন্যদিকে, ওকারার বাসিন্দাদের দাবি, মুম্বই হামলার মাস ছ’য়েক আগেও কাসভ নিজের বাড়িতে এসেছিল। মা-র থেকে আশীর্বাদ নিয়েছিল। জিহাদের জন্য?
আরও পড়ুন : কুখ্যাত ২২ অক্টোবরের স্মৃতি আজও দগদগে! কোনও দিন কি ফুরোবে কাশ্মীরের ‘কালো অধ্যায়’?
কাসভের বারবার মনে হয়েছিল, তার ফাঁসি হতে পারে না। ভারতের আইনব্যবস্থা নাকি তেমন নয়। ২০১২ সালের ১১ নভেম্বর তার ফাঁসির সাজা ঘোষণা হয়। তখনও তার ভাবভঙ্গিতে পরিবর্তন নেই। শেষমেশ ১৯ নভেম্বর যখন তাকে আর্থার রোড জেল থেকে ইয়েরওয়াড়া সেন্ট্রাল জেলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তখন তার হাবভাব বদলে যায়। অফিসার রমেস মাহালির কথায়, ‘এই প্রথম কাসভের মুখে মৃত্যুভয় দেখা গেল।’ একটি সাক্ষাৎকারে ওই ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দিয়েছেন তিনি। গোটা রাস্তা কাসভ একটি কথাও বলেনি। কেবল একবারই বলেছিল, ‘আপনি জিতে গেলেন। আমি হেরে গেলাম।’
মুম্বই হামলার পর ১৪টি বছর কেটে গিয়েছে। নানা ঘাত-প্রতিঘাত সামনে এসেছে দেশের। যে মুম্বই শহরের রাস্তায় মানুষের স্বপ্ন ঘোরাফেরা করে, এই একটি দিন সেখানে জায়গা নেয় হাহাকার। মোমবাতির আলো মনে করায় ওই শহিদ পুলিস অফিসারদের, তাজ-নরিম্যানের মৃত অতিথিদের। কাসভদের কালো ছায়া মুছেফেলার জন্য আরও কিছু মোমবাতি অস্ফুটে জ্বলে ওঠে, প্রতিবার।