বান্ধবীর মেয়েকে দত্তক! বাজপেয়ী আর 'মিসেস কৌলে'র বন্ধুত্বের যে রসায়ন রইল অজানাই
Atal Bihari Vajpayee Love Relation: ১৯৭৮ সালে বাজপেয়ীকে এক তরুণ সাংবাদিক প্রশ্ন করেন, "বাজপেয়ীজি, পাকিস্তান, চিন আর কাশ্মীর থাক। আমাদের মিসেস কৌল সম্পর্কে কিছু বলতে পারবেন?"
চল্লিশের দশক। গোয়ালিয়রের বিখ্যাত কলেজ। পরাধীন ভারতের পড়ুয়ারা ঘুরে বেড়াচ্ছেন কলেজ চত্বরে, হাতে বই-খাতা। লাইব্রেরির পথে দেখা দু'জনের। ভালো লাগলে হাসি ফুটে ওঠে রোদের মতো। উঠেওছিল ফুটে। তাবড় প্রাচীন বইয়ের মধ্যে নরম ভালোবাসার গন্ধ। মেলামেশার খুব যে সুযোগ আছে তা নয়। তবু, এই কলেজ লাইব্রেরিতে দুই পাঠক-পাঠিকা তো দেখা করতেই পারে। অনর্গল কথা না হোক, নীরব থেকেও কথোপকথন হতে পারে। হচ্ছিলও। বই আদানপ্রদানের মাঝে কুশল বিনিময়। স্বাধীনতার আগে প্রেম যেমন হয়, উষ্ণ কিন্তু আড়াল। যুবকের সঙ্গে দেখা হল যুবতীর। হামেশাই হয়। ভালোবাসার কথা সাদা কাগজে কলম লিখে দিয়েছে। পকেটে যত্নে মুড়ে রাখা ভালোবাসার স্বীকারোক্তি। একটি বইয়ের মধ্যে চিঠি ভরে দিলেন যুবক। যুবতী এসে তুলে নিয়ে গেলেন। বাকিটা অপেক্ষা। উত্তর আসবে অথবা প্রত্যাখ্যান- কিন্তু আসবে তো। যুবতীর সেই মায়াময় মুখখানি কোনও না কোনও অভিব্যক্তিতে তো জানান দেবেই চিঠির প্রাপ্তিস্বীকার। যুবতীও চিঠি লেখে, পাতার ভাঁজে রেখে বইকে পিওন করে পাঠিয়ে দেয় ঠিকানায়। পিওন ঠিকানা ভুল করে। অপেক্ষার ঠিকানায় এসে পৌঁছয় না যুবতীর লেখা পত্র। উত্তরহীনতাই সবচেয়ে বড় উত্তর, এই ভেবে সরে আসে যুবক। ভালোবাসা থাকে, যেমন তার থাকার কথা, অতি সঙ্গোপনে।
রেট্রো জমানার কোনও সিনেমার চিত্রনাট্য হতেই পারত। কিন্তু সব চরিত্রই বাস্তবিক। যুবক আমাদের প্রয়াত প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী, আর যুবতী তাঁর দীর্ঘদিনের বান্ধবী। আজীবন বিয়ে করলেন না অটল, যুবতী করলেন। বান্ধবীর মেয়েকে, নাতনিকে দত্তক নিয়ে নিলেন তাঁর বন্ধু অটল, কবি অটল, দেশের প্রধানমন্ত্রী অটল। অটল বিহারী বাজপেয়ী আর তাঁর এই বান্ধবীর গল্প অতি যত্নে সমস্ত চটুল কলুষ থেকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন দু'জনেই। অটল বিহারী শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের ঠিক চার বছর আগে, দিল্লির কৃষ্ণ মেনন মার্গের বাড়িতেই মৃত্যু হয়েছিল এই বন্ধুর। মিডিয়ার কোনও ঝলকানি ছিল না। ২০১৪ সালের ৩ মে তৎকালীন কংগ্রেস সভানেত্রী সনিয়া গান্ধী এসেছিলেন শেষ শ্রদ্ধা জানাতে। শ্মশানে এসেছিলেন লালকৃষ্ণ আডবানী, অমিত শাহরাও।
আরও পড়ুন- মোদি নন, বাজপেয়ীই প্রকৃত বিজেপি! অটল বিহারীর স্মৃতিসৌধে গিয়ে কোন বার্তা দিলেন রাহুল?
ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী আর তাঁর দীর্ঘদিনের বন্ধু রাজকুমারী কৌলের বন্ধুত্বের রয়াসন ছিল এমনই নিখাদ যে তাতে কোনও আঁচড় কাটেইনি সামাজিক চর্চা। বহু বহু দশক ধরে অটল বিহারী বাজপেয়ীর প্রাণের সখী ছিলেন রাজকুমারী কৌল। এমনকী অটল বান্ধবীর পরিবারের সঙ্গে থেকেওছেন দীর্ঘ দীর্ঘকাল! রাজকুমারী কৌলের স্বামীর মৃত্যুর পর বাজপেয়ী তাঁর মেয়ে নমিতাকে দত্তক নেন। বান্ধবীর সন্তানকে দত্তক নেওয়ার পর সামান্য কানাঘুষো শোনা যায় ঠিকই। তবে বন্ধুত্বের যে নিপাট শীতলপাটি বিছিয়েছিলেন অটল এবং রাজকুমারী তাতে এসব অনধিকার চর্চার ঠাঁই হয়নি। রাজকুমারী কৌল আসলে কে? তাঁর পরিচয় জানতে ফিরে যেতে হবে ফের সেই চল্লিশের দশকেই।
অটল বিহারী বাজপেয়ী এবং রাজকুমারী হাকসার তখন গোয়ালিয়রের ভিক্টোরিয়া কলেজে (পরে যার নাম হয় লক্ষ্মীবাই কলেজ) যান। চরম রক্ষণশীল পরিবেশ। তবু চিঠির আদানপ্রদান হয়ে যায়ই যুবক যুবতীদের। ছেলে আর মেয়ের সহজ বন্ধুত্বকে খোলা মনে মেনে নেওয়ার ধক ছিল না সময়ের। দেশভাগের আগে আগে এই রক্ষণশীলতার ফাঁদেই পড়ে থমকে যান বাজপেয়ী এবং রাজকুমারী হাকসার। অটল তাঁদের কলেজের লাইব্রেরিতে বইতে রেখে যাওয়া চিঠিতে রাজকুমারীর প্রতি তাঁর অনুভূতি প্রকাশ করেছিলেন বলে জানা যায়। রাজকুমারীও উত্তর দিয়েছিলেন, কিন্তু সেই বইটি আর কখনই অটলের কাছে পৌঁছয়নি।
তখন দেশভাগের উত্তাল সময়। দাঙ্গার নগ্নতা দেখছে ভারতবর্ষ। অটল আর রাজকুমারীর সফর দুই পৃথক পথ ধরে নেয়। রাজকুমারীর কাশ্মীরি পণ্ডিত বাবা গোবিন্দ নারায়ণ হাকসার কাশ্মীরি পণ্ডিত ব্রিজ নারায়ণ কৌলের সঙ্গে বিয়ে দেন মেয়ের। অটল এবং রাজকুমারীর একে অপরের প্রতি ভালো লাগার কথা জানা থাকলেও গোবিন্দ নারায়ণ হাকসার তাঁর মেয়েকে মধ্যবিত্ত পরিবারের অটলের সঙ্গে বিয়ে দিতে চাননি। রাজকুমারীরা সম্ভ্রান্ত, উচ্চবিত্ত। রক্ষণশীলতার পাশে দেওয়াল গড়ে দেয় সামাজিক মর্যাদাও। বিয়ের পর দিল্লিতে চলে আসেন রাজকুমারী। আর অটল প্রথমে কানপুর এবং তারপর লখনউতে চলে যান। ব্রিজ নারায়ণ কৌল দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের রামজাস কলেজের অধ্যাপক ছিলেন এবং পরে রামজাস হোস্টেলের ওয়ার্ডেনও হন। এর বহু বছর পরে, যখন অবিবাহিত বাজপেয়ী সম্পূর্ণ সময়ের রাজনীতিবিদ হয়ে উঠেছেন, জীবন তাঁর সফরের মোড় ঘুরিয়ে দিল দিল্লির পথে। দিল্লিতে তাঁর ফের দেখা রাজকুমারীর সঙ্গে, তখন রাজকুমারী রামজাস কলেজের অধ্যাপক বিএন কৌলের স্ত্রী, মিসেস কৌল।
ষাটের দশকে অধ্যাপক কৌল তখন রামজাস হোস্টেলের কড়া ওয়ার্ডেন। হামেশাই আবাসিক ছাত্রদের সঙ্গে ঝামেলা! দেরি করে ফেরা হোক, হালকা মদ্য পান বা নেশা- সব খবর পৌঁছে যায় ওয়ার্ডেনের কাছে। ওয়ার্ডেন কৌল তখন কড়া শাস্তির বন্দোবস্ত করেন। আবাসিকদের কেউ কেউ ঠিক করলেন এভাবে ওয়ার্ডেনকে সামলানো যাবে না। হাতে পায়ে ধরতে হবে ওয়ার্ডেনের স্ত্রী মিসেস কৌলের। শোনা যায়, ওয়ার্ডেনকে নিয়ে অভিযোগ জানাতে যখন ছাত্ররা দল বেঁধে রাজকুমারীর কাছে যান, তাঁরা দেখেন সেখানে রয়েছেন অটল বিহারী বাজপেয়ী। এর পর বেশ কয়েক বছরই অটল বিহারীকে কৌল পরিবারের সঙ্গে দেখা গিয়েছে। আরও কিছুকাল পরে অটল বিহারী কৌল পরিবারের সঙ্গেই থাকতে শুরু করেন।
আরও পড়ুন- ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ বুঝতেন অটল বিহারী, বাজপেয়ীর বিজেপির থেকে কোথায় আলাদা মোদির বিজেপি?
১৯৭৮ সাল নাগাদ, যখন অটল বিহারী বাজপেয়ী মোরারজি দেশাই সরকারের বিদেশমন্ত্রী, ব্রিজ নারায়ণ কৌল, তাঁর স্ত্রী রাজকুমারী কৌল এবং তাঁদের কন্যারা সবাই ৫, রাইসিনা রোডের বাড়িতে চলে আসেন অটলের সঙ্গে। অটল বান্ধবী রাজকুমারীর মেয়ে নমিতাকে এবং পরে তাঁর নাতনি নীহারিকাকে দত্তক নেন। রাজকুমারী কৌলের সঙ্গে অটল বিহারী বাজপেয়ীর বন্ধুত্ব নিয়ে মিডিয়া ট্রায়াল অবশ্য বসেনি। এ যেন এক অলিখিত প্রটোকল, যা কোনও সংবাদ মাধ্যমই কোনওদিন লঙ্ঘন করেনি, বাজপেয়ীও কখনও এই বন্ধুত্ব ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন বোধ করেননি। জীবনের একমাত্র সাক্ষাৎকারে রাজকুমারী নিজেই জানিয়েছিলেন, অটল বিহারী বাজপেয়ীর সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব এমনই নিখাদ যে তা সবার বোঝার ক্ষমতাও নেই আর তাঁর স্বামীর সঙ্গে রাজকুমারীর সম্পর্ক এতটাই শক্তিশালী যে এই গুজব তাঁদের কোনও অশান্তির মধ্যে ফেলতেও পারে না।
২০১৮ সালের ১৬ অগাস্ট প্রয়াত হন অটল বিহারী। মেয়ে নমিতাই মুখাগ্নি করেন। রাজকুমারী আর বাজপেয়ীর সম্পর্ক কেমন ছিল তা নিয়ে রসিক বুদ্ধিমান অটল নিজেই একটি দুর্দান্ত মন্তব্য করেছিলেন। ১৯৭৮ সালে বাজপেয়ীকে এক তরুণ সাংবাদিক প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন, "বাজপেয়ীজি, পাকিস্তান, চিন আর কাশ্মীর থাক। আমাদের মিসেস কৌল সম্পর্কে কিছু বলতে পারবেন?" স্তব্ধতা নেমে এল। বাজপেয়ী কিছুক্ষণ ভাবলেন, তারপর শান্তভাবে নিজস্ব ভঙ্গিতে হাসিমুখে উত্তর দিলেন, "কাশ্মীর জাইসা হি মামলা হ্যায়।"