আর কিছুদিনেই পরিত্যক্ত নগরী হতে চলেছে রাজধানী দিল্লি! বিষের বাষ্পে যে ইঙ্গিত
Delhi Air Pollution: দিল্লির নিজস্ব দূষণ তো আছেই, তার সঙ্গে যোগ হয় পঞ্জাব, হরিয়ানা, রাজস্থান এবং উত্তরপ্রদেশের ফসলের গোড়া পোড়ানো ধোঁয়া।
আপনি যদি এখন দিল্লি লিখে গুগলে সার্চ করেন, তাহলে দেখবেন পুরো দিল্লিই লালে লাল। নাহ, কমিউনিস্ট বিপ্লব ঘটেনি। দেশে এখন দখিনা হাওয়াই বইছে। ভারত লাতিন আমেরিকা হয়ে যায়নি এখনও। কিন্তু এই লালে লাল হয়েছে সম্পূর্ণ অন্য কারণে। যে কারণের সঙ্গে বিগত এক দশক ধরে দিল্লির সরকার লড়াই করার চেষ্টা করছে, কিন্তু চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ। হ্যাঁ, এটা ঠিকই যে ব্যর্থতার দায় সম্পূর্ণভাবে তাদের দিকে ঠেলে দেওয়া যায়না। কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন সরকারের দায়িত্ব থাকে দিল্লির উপর অন্য রাজ্য থেকে ঘনিয়ে আসা বিপদ ঠেকানোর। কিন্তু প্রত্যাশিতভাবেই সেই কাজে তাদের ব্যর্থতা হিমালয় পর্বতসম।কথা হচ্ছে দিল্লির বায়ু দূষণ নিয়ে। এখন বছরের সেই সময় যখন দিল্লির বাতাসের গুণমান পৌঁছে যায় চূড়ান্ত অস্বাস্থ্যকর পর্যায়ে। শিশুদের বিদ্যালয়ে যাওয়া বন্ধ, ৫০ শতাংশ সরকারি কার্যালয় বন্ধ, সমস্ত রকম নির্মাণকাজ বন্ধ, এমনকী শিশুদের মাঠে গিয়ে খেলাও বন্ধ। দিল্লি আবার পরিণত হয়েছে গ্যাস চেম্বারে। বাতাসের গুণমান এতটাই দুর্বল এবং অস্বাস্থ্যকর যে ওই অঞ্চলের মানুষ নিজেদের সন্তানদের নিয়ে শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছেন।
দিল্লির AQI এখন ৪৫০-এর নিচে নামছে না। অর্থাৎ বিপদসীমার অনেক উপরে। বাতাসের এই করুণ অবস্থার জন্য দায়ী কে এবং কী? দিল্লির নিজস্ব দূষণ তো আছেই, তার সঙ্গে যোগ হয় পঞ্জাব, হরিয়ানা, রাজস্থান এবং উত্তরপ্রদেশের ফসলের গোড়া পোড়ানো ধোঁয়া। কিন্তু অন্যান্য প্রদেশের ধোঁয়া, যা দিল্লির এই সময়ের বাতাসের পিছনে প্রায় ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ দায়ী, তা এইভাবে দিল্লির আকাশেই এসে কেন জড়ো হয়?
এর পিছনে দায়ী দিল্লির ভৌগোলিক অবস্থান। দিল্লির উত্তর-পূর্বে থর মরুভূমি, দক্ষিণ-পশ্চিমে হিমালয় পর্বত। দিল্লিকে ঘিরে থাকা এই সমস্ত রাজ্যে যখন ফসলের গোড়া পোড়ানো হয়, তখন পশ্চিমের উপকূল থেকে আসা বাতাস সমস্ত দূষণকে কাঁধে নিয়ে এসে পড়ে এই অঞ্চলে। যেহেতু দিল্লির অবস্থান হিমালয়ের পূর্বে একটি পকেটের মতো স্থানে সেই কারণে বায়ুর ধীর গতিবেগ এবং বাতাসের নিম্নগামী গতিপথ দিল্লিকে পরিণত করে তোলে গ্যাস চেম্বারে। সহজ করে যদি বলা যায়, তাহলে দিল্লির অবস্থান একটি বাটির পৃষ্ঠতলের একেবারে মাঝখানে। বাতাস এখানে পৌঁছে যায় বেশ দ্রুত গতিতেই। কিন্তু বেরনো বেশ কঠিন।
আরও পড়ুন- হিন্দুদের পবিত্র তীর্থে মারাত্মক দূষণ! আবার কি বিপর্যয়ের মুখোমুখি হবে চারধামের এই ধাম?
সেই সঙ্গে আরও একটি ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো বাতাসের গতিবেগ। অক্টোবরের শেষ থেকেই এই অঞ্চলে বাতাসের গতিবেগ থাকে মাত্র এক থেকে তিন মিটার প্রতি সেকেন্ডে। যা বছরের বাকি সময়ের তুলনায় প্রায় এক তৃতীয়াংশ। সম্প্রতি একটি গবেষণায় প্রায় উনিশ বছরের তথ্য ব্যবহার করে দেখা গেছে, দীপাবলির পর থেকেই দিল্লির বাতাসে দূষণের মাত্রা বৃদ্ধি পায় ৪০ থেকে ৮০ শতাংশ। যা জাতীয় গড়ের থেকে প্রায় দ্বিগুণ। কোনও স্থানে তিন থেকে চার গুণ বেশি। বাতাসের গতিবেগ অন্যতম বড় কারণ দূষণের মাত্রা এই হারে পৌছে যাওয়ার পিছনে।
কিন্তু এই পরিস্থিতি শুধুমাত্র ভৌগোলিক অবস্থান এবং বাতাসের গতিবেগের কারণে সৃষ্টি হয় না। শুধুমাত্র ফসলের গোড়া পোড়ানোর কারণে দিল্লিতে AQI (Air Quality Index) ৪৭২-এ পৌঁছে যায় না। দিল্লিকে ঘিরে রয়েছে ছয়টি তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র। তার মধ্যে দু'টি কয়লাচালিত এবং বাকি চারটি গ্যাসচালিত। আশ্চর্যের বিষয় হল, রাজধানী থেকে মাত্র তিন কিলোমিটারের মধ্যেই এই কয়লাচালিত তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলি অবস্থিত। তার মধ্যে অন্যতম হল বদরপুর তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র। এই তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়ে সবথেকে বড় অভিযোগ, এর কাজ করার সময়সীমা ইতিমধ্যেই পেরিয়ে গিয়েছে। বদরপুরের সবকটি ইউনিটের বয়স ৩০ থেকে ৪০ বছরেরও বেশি এবং তার যথাযথভাবে সংস্কারও করা হয়নি। খুব স্বাভাবিকভাবেই এই বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বাতাসে প্রচুর পরিমাণে ছাই এবং বিষাক্ত গ্যাস মেশে এবং দূষণের মাত্রা বৃদ্ধি করে। ২০২০ সালে দূষণের মাত্রা এতটাই বেশি ছিল যে দিল্লির সরকার কেন্দ্রীয় সরকারকে বলতে বাধ্য হয় এই তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলিকে বন্ধ করার জন্য।
কয়েক বছর আগে দিল্লির কেজরিওয়াল সরকার চালু করেছিল জোড়-বিজোড় পদ্ধতি। দিল্লির রাস্তায় শুধুমাত্র ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যাই এত বেশি যে দূষণ কমাতে সরকারকে এই পদক্ষেপ করতে হয়েছিল। সেই নিয়ম অনুযায়ী, সপ্তাহের তিন দিন যে সমস্ত গাড়ির নম্বর জোড় সংখ্যা তারা রাস্তায় নামতে পারে এবং বাকি দিনগুলি বিজোড় সংখ্যার গাড়ি। দিল্লিতে গাড়ির সংখ্যা অত্যধিক এবং সেই সংখ্যা কমার বিশেষ লক্ষণও চোখে পড়ছেনা এখনও পর্যন্ত। এই বছরের রিপোর্ট বলছে, দিল্লির এই দূষণের পিছনে শুধুমাত্র যানবাহনের অবদান থাকতে পারে ৫১ শতাংশ পর্যন্ত। গত সপ্তাহেই বেশিরভাগ দিন দিল্লির প্রধান ১৫ টি রাস্তা প্রায় অবরুদ্ধ ছিল গাড়ির চাপে। গড় গতিবেগ ছিল ২৭ কিমি থেকে ৩১ কিমি। একেই বাতাসের গতি কম, তার উপর যোগ হয়েছে ধীর গতিতে চলা লক্ষাধিক গাড়ি। PM ২.৫ এর পরিমাণ এই হারে বৃদ্ধি পাওয়ার পিছনে শুধুমাত্র যানবাহন এবং রাস্তার ধুলোকে দায়ী করা হচ্ছে।
তার সঙ্গে রয়েছে নির্মাণকাজ। সারা বছর ধরেই দিল্লির বেশিরভাগ স্থানে অবৈজ্ঞানিক ভাবে নির্মাণ সামগ্রীকে ব্যবহার করা হয়। নিয়ম মানার ধারে কাছ দিয়েও যায়না কোনও নির্মাণ সংস্থা। ফলে সেইখান থেকে ধুলো, ধোঁয়া সারা বছরই দিল্লিকে দূষিত করে। অক্টোবরের শেষে এসে সরকারের টনক নড়ে এবং তখন তারা নির্মাণকাজ বন্ধ করে পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টা করেন।
আরও পড়ুন- আপাতত দিল্লিতে বাজিমাত কেজরির! রাজধানীতে আটকানো যাবে ‘পদ্ম ফোটাও অভিযান’?
আরও কিছু বিষয় রয়েছে, যা ভারতের মতো শক্তিশালী, পৃথিবীর পঞ্চম শক্তিশালী অর্থনীতির রাজধানীতে এখনও হয় তা ভাবলে অবাকই হতে হয়। কোটি কোটি টন যে আবর্জনা জমা হয়, তাকে এখনও আগুন দিয়ে খোলা মাঠে পোড়ানো হয়। হ্যাঁ, এত ভুক্তভোগী হওয়ার পরেও এই ধরনের কার্যকলাপ বন্ধ করা সম্ভব হয়নি। সেই সঙ্গে সম্ভব হয়নি প্রায় নয় হাজার রেস্তোরাঁকে কয়লা পুড়িয়ে খাবার তৈরি থেকে বিরত করাও।
এই সমস্ত কারণগুলির প্রতি রাজ্য এবং কেন্দ্রের সরকার যদি যত্নশীল হতো, তাহলে প্রত্যেক বছরের মতো এই বছরও শীতের ঠিক শুরুতে বিদ্যালয়, ব্যবসা বাণিজ্য বন্ধ করে পরিস্থিতি সামাল দিতে হতো না। ইতিমধ্যেই এই ক্রমবর্ধমান বায়ুদূষণ রোধে ব্যবস্থা নেওয়ার আবেদন জানিয়ে সুপ্রিম কোর্টে একটি জনস্বার্থ মামলা দাখিল করা হয়েছে এবং আগামী ১০ নভেম্বর প্রথম শুনানির দিন ধার্য হয়েছে। জন সাধারণকে পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে এই আপৎকালীন পরিস্থিতিতে যতটা সম্ভব নিজেকে গৃহবন্দি করে রাখার। সেই সঙ্গে আগামী ৮ নভেম্বর পর্যন্ত সমস্ত বিদ্যালয়গুলিকে বলা হয়েছে অনলাইন ক্লাস করাতে। বৈদ্যুতিক এবং সিএনজি ছাড়া দিল্লিতে বাকি সমস্ত ট্রাকের প্রবেশও এখন নিষিদ্ধ।
রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় সরকার প্রত্যেক বারের মতো এই বারেও একে অপরের দিকে কাদা ছুঁড়েছে। কিন্তু স্থায়ী কোনও সমাধানের রাস্তা খুঁজে পাওয়া যায়নি। কেজরিওয়াল দীপাবলিতে আতসবাজি নিষিদ্ধ করেছেন, আর বিজেপি নেতারা চিৎকার করে বলেছেন আতসবাজি পোড়ানো তাদের জন্মগত অধিকার। এখনও পর্যন্ত কোনও রকম সমন্বয়ের চেষ্টা দেখা যাচ্ছেনা নরেন্দ্র মোদির দলের তরফ থেকে। আছে শুধুমাত্র রাজনীতি। প্রশ্ন একটাই, রাজনৈতিক নেতারা কি সুপারম্যান? তারা একই বাতাস থেকে অক্সিজেন গ্রহণ করেন না? নাকি স্থায়ী সমাধান খোঁজার চেষ্টা বৃথা? তাতে বাজার গরম করে ভোট জেতা যায়না? উত্তর নেই।