কানাডায় হামলা শাহের 'নির্দেশে'! কেন নতুন করে অভিযোগ?
কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর অভিযোগ, অমিত শাহের নির্দেশে কানাডায় শিখ সম্প্রদায়ভুক্তদের উপর হামলা এবং ভীতিপ্রদর্শনের ঘটনা ঘটছে
শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা হরদীপ সিং নিজ্জরের হত্যা মামলাকে কেন্দ্র করে ভারত ও কানাডার মধ্যে আবারও বিবাদের সৃষ্টি হয়েছে। ভারতীয় সংবাদ সংস্থা রয়টার্সের তথ্য অনুযায়ী, হরদীপের হত্যার ঘটনায় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে কাঠগড়ায় তোলা হয়েছে। অভিযোগ, অমিত শাহের নির্দেশে কানাডাতে শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের উপর হামলা এবং ভীতিপ্রদর্শনের ঘটনা ঘটছে। এই অভিযোগ তুলেছেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো নিজে। উল্লেখ্য,এ হেন অভিযোগে অস্বস্তিতে পড়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও। মার্কিন বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র ম্যাথু মিলারের বক্তব্য, ‘‘এমন অভিযোগ উদ্বেগজনক। এ নিয়ে কানাডা সরকারের সঙ্গে কথাবার্তা চালিয়ে যাব।’’ এই ঘটনা সামনে আসার পর থেকে কানাডা ও ভারতের মধ্যে আবার সংকট দেখা দিয়েছে। কেন আবার নতুন করে অভিযোগ তুলছে কানাডা?
মঙ্গলবার আমেরিকার সংবাদপত্র ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিবেদনে লেখা হয়েছে, কানাডার মন্ত্রী ডেভিড মরিসন মঙ্গলবার সংশ্লিষ্ট পার্লামেন্ট কমিটিকে জানিয়েছেন, শাহের নির্দেশে কানাডাতে শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের উপর হামলা এবং ভীতিপ্রদর্শনের ঘটনা ঘটছে। এবং মোদি সরকারের শাহের কথায় কানাডায় খলিস্তানপন্থীদের সম্পর্কে গোয়েন্দাদের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। রয়টার্সের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ডেভিড মরিসন বলেন, 'ওয়াশিংটন পোস্টের সাংবাদিক আমাকে ফোন করে জিজ্ঞাসা করেছিলেন উনিই (অমিত শাহ) সেই ব্যাক্তি কিনা? আমি তাঁকে নিশ্চিত করেছি যে তিনিই সেই ব্যক্তি।' রয়টার্সের তাদের প্রতিবেদনে লিখেছে, ভারতীয় হাইকমিশন এবং ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাথে যোগাযোগ করা হলেও তখনই তারা এই নিয়ে কোনো মন্তব্য করেনি। ১৪ অক্টোবর সর্বপ্রথম মার্কিন দৈনিক ওয়াশিংটন পোস্টই এই বিস্ফোরক অভিযোগ সামনে এনেছিল। বলে রাখা দরকার, কানাডা সরকার এই সকল অভিযোগের কোনো প্রমাণ এখন সামনে আনেনি।
ডেভিড ছাড়াও ওয়াশিংটন পোস্টকে এই তথ্য জানিয়েছিলেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর জাতীয় নিরাপত্তা এবং গোয়েন্দা উপদেষ্টা নাথালি দ্রোউইন। ওয়াশিংটন পোস্টের ঠিক দু'দিন আগে কানাডার মাউন্টেড পুলিশ সাংবাদিক বৈঠক করে দাবি করেছিল, ভারত সরকার লরেন্স বিষ্ণোই গ্যাং-এর সাথে মিলে কাজ করছে। বিষ্ণোই গ্যাং-এর সদস্যদের দক্ষিণ এশিয়ায় স্বার্থসিদ্ধিতে কাজে লাগাচ্ছে ভারত। দাবি করা হয়েছে, বিষ্ণোই গ্যাং-এর সাথে যোগসূত্র রয়েছে ভারতের। অভিযোগ উঠছিল, কানাডাবাসী দক্ষিণ এশিয়াদের বিষয়ে তথ্য জানতে এদের সাহায্য নেয়। কানাডার সোর্সের কথা উল্লেখ করে এই সংবাদপত্রটি আরও দাবি করে, নিজ্জর হত্যাকাণ্ড সংক্রান্ত ইনটেল-ইনপুট কানাডা শেয়ার করে ভারতের বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্করকেও। সিঙ্গাপুরে ভারত-কানাডার গোপন মিটিং হয় বলে লেখা হয়েছে ওই প্রতিবেদনে।
মার্কিন ওই সংবাদপত্রের লিখেছিল, কানাডায় খলিস্তানি জঙ্গিদের সম্পর্কিত তথ্য জোগাড় করার দায়িত্ব ছিল ভারতীয় কূটনীতিকদের। প্রাপ্ত তথ্য দিয়ে দেওয়া হত ভারতীয় গুপ্তচর সংস্থার হাতে। এর পরের কাজ দেওয়া ছিল বিষ্ণোই গ্যাং-কে। ওই গ্যাংস্টাদের সুপারি দিয়ে কাজ করিয়ে নেওয়া হত। প্রথম থেকেই ভারত সরকার এই দাবি প্রত্যাখ্যান করে এবং প্রমাণও চায়। এর আগেও একাধিকবার কানাডায় খলিস্তানিপন্থীদের উপর হামলাতে ভারতকে নিশানা করেছে কানাডা সরকার। গত বছর পার্লামেন্টে দাঁড়িয়েই কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো অভিযোগ তুলেছিলেন, হরদীপ সিং নিজ্জরের হত্যার ঘটনায় ভারতের সংযোগ রয়েছে। ২০২৪ সালের মে মাসের প্রথম সপ্তাহে ট্রুডো নিজ্জর হত্যা মামলায় 'ভারতের সরকারের এজেন্টদের' জড়িত থাকার অভিযোগ করেন। যদিও ভারত এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে।
১৩ অক্টোবর কানাডা সরকারের একটি বিবৃতিতে বলা হয়েছিল, নিজ্জর হত্যাকাণ্ডে কানাডায় নিযুক্ত ভারতীয় হাই কমিশনার সঞ্জয় কুমার বর্মার নাম রয়েছে। এই বিবৃতির পর কানাডা থেকে সঞ্জয় এবং আরও ৫জন কূটনৈতিককে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল। এই দিনই ভারত সরকার কানাডিয়ান হাইকমিশনার ও অন্যান্য কূটনীতিক ও কর্মকর্তাদের প্রত্যাহারের ঘোষণা করে। মোদি সরকারও অভিযোগ তোলে, কানাডায় আসন্ন পার্লামেন্ট নির্বাচনকে লক্ষ্য করে ট্রুডো সরকার নতুন করে নিজ্জর খুনের ঘটনার জলঘোলা করছে, যাতে কট্টরপন্থী খালিস্তানি গোষ্ঠীগুলোর সমর্থন সহজেই পাওয়া যায়। সে সময় কানাডার অভিযোগগুলো ভিত্তিহীন বলেই উড়িয়ে দিয়েছিল ভারত সরকার।
২০২৩ সালের ১৮ জুন হরদীপকে ব্রিটিশ কলম্বিয়ার সারের একটি গুরুদ্বারের সামনে তাঁকে হত্যা করা হয়। এই হত্যাকাণ্ডে খুনে জড়িত সন্দেহে কয়েকজন ভারতীয় ও ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্যাক্তিকে গ্রেফতার করেছিল কানাডার পুলিশের ইন্টিগ্রেটেড হোমসাইড ইনভেস্টিগেশন টিম (আইএইচআইটি)। এ বছর এপ্রিল মাসে কানাডার নিরাপত্তা বিষয়ক গোয়েন্দা সংস্থা (সিএসআইএস) তাদের তদন্ত রিপোর্টের একটি অংশ প্রকাশ করে, সেখানে উল্লেখ ছিল, ২০১৯ ও ২০২১ সালের সাধারণ নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে ভারত ও পাকিস্তান গোপনে সক্রিয় ছিল। গত সপ্তাহে কানাডার প্রধানমন্ত্রী আবার বলেছিলেন, ভারত সরকার নাকি কানাডার সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করছে, এটি ভারতের বড় ভুল।
আরও পড়ুনঃখালিস্তানি হত্যায় সত্যি জড়িয়ে ভারত? কেন ছয় কূটনীতিককে বহিষ্কার করল কানাডা?
হরদীপ সিং নিজ্জর কানাডার ভ্যাঙ্কুভারে গুরু নানক শিখ গুরুদ্বারের সভাপতি ছিলেন। তিনি জলন্ধরের ভার সিং পুরা গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন। ভারত সরকারের তথ্য অনুযায়ী, নিজ্জর খালিস্তান টাইগার ফোর্সের প্রধান ছিলেন। তিনি 'শিখস ফর জাস্টিস'-সংগঠনের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। এই সংগঠন ভারতে নিষিদ্ধ। স্বাধীন শিখ রাষ্ট্র খালিস্তান গঠনের প্রচারভিযান চালানোর জন্য ভারত সরকার এই সংগঠনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল। ভারত সরকার আগেই খালিস্তানি বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা হরদীপ সিং নিজ্জরকে সন্ত্রাসবাদী বলে ঘোষণা করেছিল।
ভারত সরকার বার বার দাবি করেছে, কানাডা সরকার সাধারণ নির্বাচন জিততে ভোট ব্যাঙ্কের রাজনীতি করছে। ট্রুডো তাঁর রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে কানাডায় খালিস্তান সমর্থকদের পক্ষে কথা বলছে। উল্লেখ্য, কানাডার জনসংখ্যার ২.১% শিখ সম্প্রদায়ভুক্ত। গত ২০ বছরে এই সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। জাস্টিন ট্রুডো ২০১৫ সাল থেকে ক্ষমতায় রয়েছেন। ২০১৯ ও ২০২১ সালে ট্রুডো একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। ভারতীয় বংশোদ্ভূত জগমিত সিং-এর দল এনডিপি সাথে জোট সরকার করেছিলেন। যদিও এ বছর সেপ্টেম্বর মাসে সমর্থন তুলে নেন জগমিত। ওয়াশিংটন পোস্টের তথ্য অনুযায়ী, একটা সময় জগমিতও খালিস্তানের সভায় যোগ দিতেন। ভারতকে নিয়ে সমালোচনাও করতে দেখা গেছে তাঁকে। ট্রুডোর প্রথম মেয়াদে যখন মন্ত্রীসভা গঠন করেছিলেন, তখন সেখানে ৪ জন শিখ মন্ত্রী ছিলেন। ট্রুডো সরকারের কাছে যে শিখ সম্প্রদায়ের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে তা আন্দাজ করা যায়।
সম্প্রতি কানাডার পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেলানি জোলি বলেছেন, কানাডার কাছে ভারতের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করার মতো বিকল্প রয়েছে। অক্টোবরের শুরুতে ট্রুডো অভিযোগ তুলেছিলেন, ভারত সরকার নিজ্জর খুনের ঘটনায় সহযোগিতা করছে না। এই হত্যা মামলা নিয়ে ভারতও ব্যাপক ক্ষুব্ধ। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ভারতের সাথে আর কোনো পশ্চিমা দেশের সম্পর্ক এমন তলানিতে ঠেকেনি। কোল্ড ওয়ারের পর ভারত মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে ভাল সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল। ভারত জি-৭ ও ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোর সঙ্গে অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক সম্পর্ক উন্নতি করতে চাইছে। কানাডা আবার এই দুই গ্রুপেরই সদস্য। অন্যদিকে, কানাডার আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ সামরিক সম্পর্ক আছেই।
আরও পড়ুনঃ কলের মিস্ত্রির মুখোশে খলিস্তানি জঙ্গি! ভারত-কানাডা সম্পর্কের কাঁটা হরদীপ আসলে কে?
এখানে বলে রাখা দরকার, খালিস্তানপন্থী নেতা গুরপতবন্ত সিং পান্নুকে হত্যার ষড়যন্ত্র মামলায় ভারতের হাত রয়েছে বলে অভিযোগ করেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এই অভিযোগের তদন্তের জন্য ভারত সরকার একটি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠনের ঘোষণা করে। গত বছর মার্কিন ফেডারেল আদালত নিখিল গুপ্তা নামে এক ভারতীয় ব্যাক্তিকে এই আদালত পান্নুর হত্যাকাণ্ডের ষড়যন্ত্রের অভিযোগে অভিযুক্ত করে। অনেকেই মনে করেন, ভারতের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের কারণেই এই মামলাকে গুরুত্বের সাথে দেখা হয়েছিল। পান্নু 'শিখস ফর জাস্টিস'-সংগঠনের মুখপত্র এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার দ্বৈত নাগরিক ছিলেন।
কানাডা ও ভারতের এই বিবাদের শেষ কোথায় তা বোঝা মুশকিল। ২০২৪ অক্টোবরে কানাডার সাধারণ নির্বাচনে ট্রুডো যদি জিতে আবার ক্ষমতায় ফেরে ভারতের প্রতি তাঁর অবস্থান পরিবর্তন হওয়ার সম্ভবনা অত্যন্ত কমই রয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। অনেকেই আবার এও দাবি করছেন যে, এই মুহূর্তে ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে, ভারত ও কানাডার সম্পর্ক বেশি খারাপ। যদিও কানাডা সরকার এই অভিযোগগুলোর কোনো প্রমাণ দেয়নি বলে দাবি করেছে ভারত সরকার। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা দাবি করছেন, এমন গুরুতর অভিযোগ ওঠা সত্ত্বেও তেমন কড়া জবাব মেলেনি ভারত সরকারের পক্ষ থেকে। রাবিশ কুমার তাঁর ইউটিউব ভিডিও-তে দাবি করেছেন, এই ধরনের অভিযোগ ভারতের পক্ষে ভাল নয়। তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, কেন এই অভিযোগের তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছে না ভারত?