৩টি গুলি খেয়েও জঙ্গিকে কামড়ে ধরেছিল অ্যাক্সেল, সেনা অভিযানে কেন গুরুত্বপূর্ণ কুকুর?
Military Dog: বিশ্বজুড়েই সশস্ত্র বাহিনীগুলির প্রিয় কুকুর হল এই বেলজিয়ান ম্যালিনোইস জাতের কুকুর। তারা তাদের আগ্রাসনের জন্য বিখ্যাত।
মাত্র ২ বছর বয়সেই জঙ্গিদমন অভিযানে বেশ পারদর্শী ছিল অ্যাক্সেল। এই বছরের অগাস্টের ঘটনা। কাশ্মীরের বারামুল্লায় সেনা অভিযান। অ্যাক্সেলের সঙ্গে এই অভিযানে ছিল আরও এক সেনা কুকুর বাজাজ। যে বাড়িতে জঙ্গিরা লুকিয়ে ছিল সেখানে প্রথমে পাঠানো হয় বাজাজকে কিন্তু সন্ত্রাসবাদীদের খোঁজ না পেয়ে ফিরে আসে বাজাজ। এরপরেই অ্যাক্সেলের শরীরে ক্যামেরা লাগিয়ে সেই বাড়িতেই প্রবেশ করানো হয়। বিপদ বুঝে এলোপাথাড়ি গুলি চালাতে শুরু করে জঙ্গিরা। এরপরেই সেনাও পাল্টা গুলি চালাতে শুরু করে। অভিযান শেষের পর উদ্ধার করা হয় অ্যাক্সেলের নিথর দেহ। সেনা সূত্র জানায় অ্যাক্সেলের দেহে মোট তিনটি গুলি লাগে, ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারায় সে। অ্যাক্সেল গুলিবিদ্ধ হওয়ার পরও এক সন্ত্রাসবাদীকে জড়িয়ে ধরে মারণ কামড়ও দেয়। অ্যাক্সেলের সাহসিকতায় প্রাণ বাঁচে ২ সেনা কর্মীর।
কেন আবার ফিরে এল অ্যাক্সেলের কথা? কারণ সেই প্রাচীন কাল থেকে সেনাবাহিনীতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়ে আসছে কুকুর।
মিশরীয়, গ্রিক ও রোমান সাম্রাজ্যের ইতিহাসে কুকুরের ব্যবহারের কথা জানা যায়। ২টি বিশ্বযুদ্ধেও বিভিন্ন সামরিক অভিযানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে বেশ কিছু কুকুর। বর্তমানে শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীতেই কাজ করছে বিভিন্ন প্রজাতির আড়াই হাজার কুকুর। এদের মধ্যে আবার ৭০০টি নিয়োজিত আছে বিদেশের সামরিক অভিযানে। মার্কিন বাহিনীর যে দলটি আইএস নেতা আবু বকর আল বাগদাদিকে আটক করেছিল, সেই দলটির সঙ্গে ছিল একটি কুকুর। ‘কোনান’ নামের ওই সারমেয়টি সেই অভিযানে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এতটাই যে, ওই অভিযানের পর প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প কোনও সৈনিক বা কমান্ডারের ছবি শেয়ার না করে টুইটারে কোনানের ছবি শেয়ার করেছিলেন। এরপর রীতিমতো বিখ্যাত হয়ে যায় মার্কিন সেনাবাহিনীর ডেল্টা ফোর্সের ওই কুকুরটি।
অনেক দিন ধরেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সেনাবাহিনী তাদের বিশেষ অভিযানে কুকুর ব্যবহার করে আসছে। এসব অভিযানে উন্নত প্রশিক্ষণ পাওয়া এই সারমেয়রা গুরুত্বপূর্ণ ও সাহসী ভূমিকা নেয়। মার্কিন নেভি সিল, আর্মি রেঞ্জার্সের মতো স্পেশাল ইউনিটগুলোর অবিচ্ছেদ্য অংশ এখন মিলিটারি ডগ হিসেবে পরিচিত এসব কুকুর। বিস্ফোরক খুঁজে বের করা, টার্গেটকে কাবু করা, গোপন হুমকি চিহ্নিত করার কাজে ব্যবহৃত হয় এই সারমেয়রা। যে কারণে এদের ডাকা হয় মাল্টিপারপাস ক্যানাইনস বা এমপিসি নামে। হেলিকপ্টার থেকে দড়ি বেয়ে নিচে নামা কিংবা সৈনিকদের কোলে চড়ে প্যারাস্যুট জাম্প করার প্রশিক্ষণও দেওয়া হয় এই প্রাণীদেরকে।
আরও পড়ুন- ‘আত্মা’ও কথা বলতে চায়! বিজ্ঞান নয়, বিশ্বাসে ভর দিয়ে ভূত খোঁজেন এই গোয়েন্দারা!
যুদ্ধক্ষেত্রে কুকুরের গায়ে পরানো থাকে বুলেট প্রুফ ভেস্ট। এর সঙ্গে থাকে টর্চ লাইট, ক্যামেরা, সেন্সর ও কয়েক ধরনের কমিউনিকেশন ইকুইপমেন্ট। যে কারণে হ্যান্ডলার তাঁর কুকুরকে হেলিকপ্টার থেকেও নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। ক্যামেরায় কুকুরের চলাফেরা দেখে রেডিওর মধ্যেমে তাকে কমান্ড করতে পারেন। রেডিও সিগন্যালের মাধ্যমে এক মাইল দূর থেকেও এদেরকে অপারেট করা যায়। কোনও এলাকায় সেনারা প্রবেশের আগে সেখানকার পরিস্থিতি সম্পর্কে ধারণা পাওয়ার জন্য আগে কুকুর পাঠানো হয়। কুকুর বলে দিতে পারবে জায়গাটি কতটা নিরাপদ। ২০১৮ সালের নভেম্বরে আফগানিস্তানে আল কায়েদার একটি ঘাঁটিতে ঢুকে গুলিতে নিহত হয় মাইকো নামের এক কুকুর। কুকুরটিকে আগে না পাঠিয়ে সৈন্যরা সেখানে ঢুকলে অনেক সেনার প্রাণহানি হতো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মাস্টার্ড গ্যাস আক্রমণ সম্পর্কে মিত্র বাহিনীর সৈন্যদের আগেভাগেই সতর্ক করেছিল সার্জেন্ট স্টাবি নামের সারমেয়টি।
ভারতীয় সামরিক অভিযানে বিভিন্ন সময়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়ে এসেছে কুকুর। সম্প্রতি ভারতীয় সেনাবাহিনীর সন্ত্রাসবিরোধী শাখার ক্যানাইন স্কোয়াডে যুক্ত হয়েছে বেলজিয়ান ম্যালিনোইস। কেন এই প্রজাতির কুকুরদেরই সবথেকে পছন্দ গোটা বিশ্বের সশস্ত্র বাহিনীগুলির?
এই প্রজাতির কুকুররা খুবই আগ্রাসী। তাদের আক্রমণ করার জন্য়ই বিশেষভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া যায়। সারা বিশ্ব জুড়েই সামরিক বাহিনীগুলিতে এই জাতের কুকুরকে, সেনা অভিযানের জন্য ব্যবহার করা হয়। এই প্রজাতির কুকুররা খুবই চটপটে। অসাধারণ তৎপরতা, স্মার্ট মস্তিষ্ক, অবিশ্বাস্য সহনশীলতা, বুদ্ধিমত্তা এবং সুপ্রশিক্ষিত হতে পারার জন্য সুপরিচিত। কামড়ের জোরের দিক থেকেও কুকুরদের মধ্যে তারা বিশেষ স্থানে রয়েছে। নিরাপত্তা অভিযানে যেসব প্রজাতির কুকুর সশস্ত্র বাহিনীগুলিকে সহায়তা করে, তাদের মধ্যে এই প্রজাতি অন্যতম সেরা বলে ধরা হয়।
বিশ্বজুড়েই সশস্ত্র বাহিনীগুলির প্রিয় কুকুর হল এই বেলজিয়ান ম্যালিনোইস জাতের কুকুর। তারা তাদের আগ্রাসনের জন্য বিখ্যাত। ইতিহাসে বেশ কয়েকটি বিখ্যাত সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানে অংশ নিয়েছে এই প্রজাতির কুকুর। সাম্প্রতিককালের মধ্যে, এই প্রজাতির একটি কুকুরই অ্যাবটাবাদে ওসামা বিন লাদেনকে যে সেনা অভিযানে খতম করেছিল মার্কিন সেনা, সেই অভিযানে এই প্রজাতির কুকুর জড়িত ছিল।
জার্মান শেফার্ড কুকুরও খুবই আগ্রাসী। কিন্তু, তারা আকৃতিতে বেশ বড়। বেলজিয়ান ম্যালিনোইসরা, তুলনায় আকারে ছোট হওয়ার কারণে তাদের প্যারাশুটে করে কিংবা বিমান থেকে দড়ি বেঁধে দ্রুত নামিয়ে দেওয়া যায়। ভারতে সিআরপিএফ বাহিনী তাদের নকশাল বিরোধী অভিযানে প্রথম এই জাতের কুকুরকে ব্যবহার করেছিল। পরে, আইটিবিপি, এনএসজির মতো অন্যান্য কেন্দ্রীয় সশস্ত্র পুলিশ বাহিনীও এই কুকুরদের বাহিনীতে সামিল করে।
বিদেশি কুকুরের পাশাপাশি জঙ্গি ধরতে সেনাবাহিনীতে বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে দেশি কুকুরকে। কিন্তু কেন এই ভাবনা? সূত্রের খবর ভারতীয় সেনা জার্মান শেফার্ড, ল্যাব্রাডর, বেলজিন ম্যালিনোইস ও গ্রেট স্যুইশ মাউন্টেন ডগের প্রতি ভারতীয় সেনা তাদের এতদিনকার মোহ কাটিয়ে দেশি কুকুর নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেছে। তার পিছনেও রয়েছে বেশ কিছু কারণ।
আরও পড়ুন- গীতা ছুঁয়ে শপথ, ঋষি সুনককে কেন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মানল ব্রিটেন
প্রথমত বিদেশি কুকুরদের থেকে দেশি কুকুরদের পিছনে খরচ একদিকে যেমন কম লাগবে তেমনই সব ধরনের আবহাওয়ার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে একেবারে ওস্তাদ দেশি কুকুর। ফলে জঙ্গিদের খুঁজে বার করতে অথবা বিস্ফোরক উদ্ধারে দেশি কুকুরের জুড়ি মেলা ভার, এমনটাই ধারণা করা হচ্ছে।
এছাড়াও সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে যে কাজ করতে জার্মান শেফার্ড বা ল্যাব্রাডরের ৯০ সেকেন্ড সময় লাগে, দেশি কুকুর ৪০ সেকেণ্ডের কম সময়েই তা করে ফেলতে ফেলতে সক্ষম। ইতিমধ্যেই দেশের বিভিন্ন রাজ্যের পুলিশ বাহিনীতেও জায়গা পেয়েছে দেশি কুকুর। এমনকী রাজ্য পুলিশে চাকরিও পাকা করেছে আশা নামের এক দেশি কুকুর। বিদেশি কুকুরদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে প্রশিক্ষণেও সিদ্ধহস্ত দেশি কুকুর।
২০২০ সালের অগাস্টে মন কি বাত অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ২টি কুকুর - সোফি এবং ভিদার কথা জানিয়েছিলেন। ভিদা যখন নর্দার্ন কমান্ডে নিযুক্ত ছিল, তখন সোফি ছিল স্পেশাল ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের বম্ব ডিসপোজাল স্কোয়াডে। পাঁচটি মাইন এবং একটি গ্রেনেড মাটির নিচে পুঁতে ফেলার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল ভিদা। সামরিক বাহিনীতে এই প্রাণী কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা বুঝিয়ে দেন প্রধানমন্ত্রীও। যেমন একসময়ে দিয়েছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট।