ফাইনালে মাঠে ঢুকে পড়ল ষাঁড়! বিশ্বকাপের মোড় ঘুরিয়ে দিল জিদানের ঢুঁসো...

Zinedine Zidane Headbutt: ফাইনাল ম্যাচে জ়িদানকে লাল কার্ড দেখানোর কিছুক্ষণ পরেই ইতালি পেনাল্টিতে ফ্রান্সকে হারিয়ে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হলো।

২০০২-এর বিশ্বকাপ

পৃথিবীতে তখন ধ্বংসের ঋতু চলছে। সন্ত্রাসবাদী হানায় নিউ ইয়র্কের জোড়া মিনার ধূলিসাৎ হয়ে গেল। প্রতিশোধ নিতে মার্কিন রাষ্ট্রপতি বুশ আফগানিস্তানে অবিরল বারিধারার মতো মিসাইল ছুঁড়ে ছুঁড়ে দেশটাকে তছনছ করে দিল। সেইসঙ্গে শেষ করে দিল তালিবানি একনায়কতন্ত্র। আশা করি আমরা ভুলে যাইনি, রাষ্ট্রপতি জর্জ ওয়াকার বুশের বাপ জর্জ হার্বার্ট ওয়াকার বুশ আর রোনাল্ড রেগন দুধকলা খাইয়ে তালিবান পুষেছিল। সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমে সেনাবাহিনী এতটাই স্বাধীনতা পেল যে শুরু হলো সেনা-সন্ত্রাসের নতুন অধ্যায়। ইজ়রায়েলি সাঁজোয়া গাড়ি গাজ়া আর ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক ছারখার করে দিচ্ছিল, ওদের যত রাগ ফিলিস্তিনিদের ওপর। ইহুদি গণহত্যায় ফিলিস্তিনিরা জড়িত না থেকেও সেই অপরাধের মূল্য চুকিয়ে গেল।

স্পাইডার-ম্যান বক্স অফিসে তোলপাড় ফেলে দিল। মিয়ামির সর্বজ্ঞ মাতব্বররা বলে বেড়াচ্ছিল খুব শিগগিরই নাকি ফিদেল কাস্ত্রোর পতন অনিবার্য। আর সেরেফ কয়েক ঘণ্টার অপেক্ষা শুধু! কিন্তু উলটে গেল আরহেন্তিনা, ওদের ভাষায় আদর্শ দেশ! সেদেশে এমন ঘূর্ণিপাক লাগল যে তার টানে দেশের মুদ্রা, সরকার আরও কত কী, সব জলাঞ্জলি গেল। ভেনেজ়ুয়েলায় আকস্মিক এক অভ্যুত্থান হুগো চাভেসকে ধাক্কিয়ে রাষ্ট্রপতির পদ থেকে সরিয়ে দিল। তার কিছুদিন পর যখন বিপুল জনতার কাঁধে চড়ে চাভেস ফের রাষ্ট্রপতি হলো, তখন স্বাধীন সাংবাদিকতার পরাকাষ্ঠা টেলিভিশন চ্যানেলগুলো ঘটনাটা যেন শুনতেই পেল না।

নিজের বাটপাড়ির ফাঁদে নিজেই জড়িয়ে গিয়ে বহুজাতিক দৈত্য এনরন মুখ থুবড়ে পড়ল, ওরাই আবার বুশ থেকে শুরু করে অধিকাংশ মার্কিন সেনেটরের প্রচারে সবচেয়ে বেশি টাকা ঢালে। এনরনের রাস্তাতেই গণেশ উল্টোল ডমিনোজ় কোম্পানিরও। শেয়ার বাজার শুকিয়ে গিয়ে ওয়ার্ল্ডকম, জ়েরক্স, ভিভেন্দি, মার্ক সব ডুবে গেল! সামান্যই কয়েক বিলিয়ন মার্কিন ডলারের হিসেবের গোলমালে নাকি এত বড় ঘটনা ঘটে গেল। ব্যাবসায় ফিফার ডানহাত আইএসএল এবং কিয়াশ- দু'টি কোম্পানিই ভুঁড়ি উলটে চিৎ হয়ে পড়ল। তারা দেউলে হয়ে গেলেও সেপ ব্লাটারের ক্ষমতায় টিকে থাকতে কোনও অসুবিধে হল না। সে বিপুলভাবে জিতে পুনরায় ফুটবলের সিংহাসনে আসীন হলো। সহজ সত্যিটা বুঝুন মশাই, যদি নিজেকে ভালো দেখাতে হয় তাহলে আগে এমন একজনকে খুঁজে বের করুন যার পাশে আপনাকে অসাধারণ দেখাবে। ব্লাটার হচ্ছে নিয়মকানুন হজম করে ফেলতে এবং ভোট কিনতে অপ্রতিদ্বন্দ্বী। অপ্রতিরোধ্য ব্লাটার আভেলাঞ্জিকেও নেহাত দানখয়রাতি-সমাজসেবার কাজে লাগিয়ে দিল।

আরও পড়ুন- বন্দুকের নলের মুখে অসহায় সাংবাদিক! সাক্ষাৎ মৃত্যুর হাত থেকে ফিরিয়েছিলেন এই ফুটবলার

বার্টি ফেলস্টেড, ইংল্যান্ডের প্রবীণতম মানুষটি মারা গেল। ১৯১৫-র ক্রিসমাসের দিন ব্রিটিশ আর জার্মান সেনাবাহিনী ‘নো ম্যানস ল্যান্ডে’ যে অত্যাশ্চর্য ফুটবল ম্যাচ খেলেছিল, বার্টি ছিল তার শেষ জীবিত খেলোয়াড়। কোত্থেকে তারা বল পেয়েছিল কে জানে, কিন্তু বলের এমনই জাদু যে দু'পক্ষের কাছেই যুদ্ধক্ষেত্র কিছুক্ষণের জন্য খেলার মাঠ হয়ে উঠেছিল। অবিশ্যি অচিরেই সেনাকর্তাদের হাঁকডাকে তারা বুঝে যায় যে ওখানে তাদের খেলতে ডাকা হয়নি। একে অপরকে ঘৃণা করার পবিত্র কাজে নিয়োজিত তারা। 

ওদিকে বত্রিশটা দল উড়ে গেল জাপান-কোরিয়ার কুড়িটা শহরের চকচকে নতুন স্টেডিয়ামে সপ্তদশ বিশ্বকাপের লড়াইয়ে অংশ নিতে। নতুন সহস্রাব্দের এই প্রথম বিশ্বকাপই আবার এশিয়ার মাটিতে প্রথম বিশ্বকাপ। সোলের স্টেডিয়ামে প্রথম রাত থেকে অ্যাডিডাসের দৌলতে যে উন্নত প্রযুক্তির বল গড়াতে শুরু করল, সেগুলো সেলাই করেছিল পাকিস্তানের শিশু শ্রমিকেরা। সে বলও তাক লাগিয়ে দেবার মতো! কাপড়ের জালে ভরা রবারের খোল, যার বাইরেটা ফোম দিয়ে মোড়া। সাদা পলিমারের ওপর আগুনের প্রতীক আঁকা। ঘাসের বুকে ভাগ্য ফেরানোর টোপ।

একটা নয়, সেসময় দু-দুটো বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ একসঙ্গে চলছিল : একটায় রক্তমাংসের খেলোয়াড়রা খেলছিল; অন্যটায় খেলছিল রোবটরা। যান্ত্রিক খেলোয়াড় সব, সফটওয়্যারের কামাল। কোরিয় সৈকতের উল্টোদিকে জাপানি বন্দর ফুকুয়োকা শহরে রোবটের লড়াই চলছিল। ফুটবল শিল্পে জড়িত যত ব্যাবসাদার, প্রকৌশলী, আমলা, তাত্ত্বিক- তারা ফুটবল নিয়ে কী স্বপ্ন দেখে বলুন তো?  ওদের অনেকদিনের স্বপ্ন হলো রোবটের নকলনবিশি করা। বাস্তবে আধুনিক ফুটবলও অনেকটা তাই।

বিষণ্ণ সময়ের কিছু ছাপছোপ; একবিংশ শতাব্দী শৈল্পিক দক্ষতা এবং স্বাধীনতাকে সাফল্যের বেদিমূলে জবাই করে জয়ধ্বনি দেয়। তারা সব কিছুকেই গড়পড়তা, এক ছাঁচে ঢালতে চায়। করনেলিয়াস কাস্তোরিয়াদিস অনেকদিন আগেই খেয়াল করেছিল এই প্রবণতা : "‘তুমি ভালো বলে জিতছ না, বরং জিতছ বলে তুমি ভালো"।  কাস্তোরিয়াদিস অবিশ্যি ফুটবল প্রসঙ্গে কথাগুলো বলেনি, কিন্তু বলতেই পারত। সময় নষ্ট করা যেমন অপরাধ, তেমনই হেরে আসাটাও। আজকাল আর ফুটবল খেলা হয় না, ওটাকে কেরানিগিরিতে নামানো হয়েছে, যার বিচার করতে বসে লাভক্ষতির অঙ্কটাই বড় হয়ে ওঠে। সমাজের সব কিছুর মতোই ফুটবলও নিয়ন্ত্রিত হয় কিছু সর্বশক্তিমানের হাতে, যাদের অস্তিত্ব বোঝা ভার, এমনকী তাদের নাম দেওয়া যায় ইউ ই বি (ইউনিয়ন অব এনিমিজ় অব বিউটি)। 

আরও পড়ুন- শুধু পেলের খেলা দেখবে বলে যুদ্ধ থামিয়ে দিয়েছিল দুই দেশ!

এখন সবাই চায় এগারোজন বাধ্য ছেলে, যারা এতটুকু না হাঁপিয়ে বেদম দৌড়তে পারবে, গায়ে জোর থাকবে পাথরের মতো : বিশ্বায়ন এই ছাঁচেই ফুটবলকে ঢালতে চায়। ফুটবল এখন সবার কাছে জলভাত, কিন্তু আমার ইদানিং খেলা দেখলে মনে হয় মাংসের কিমা বানাবে বলে সদ্য হিমঘর থেকে বের করে আনা হয়েছে : এ ফুটবল মানুষের নয়, রোবটের। এই বিরক্তিকর খেলাটাকেই নাকি প্রগতি বলে! ঐতিহাসিক আর্নল্ড টয়েনবি অনেক দেখে তবেই লিখেছিলেন "সভ্যতার অবক্ষয় ধরা পড়ে ধারাবাহিকভাবে সাধারণীকরণ আর একছাঁচে ঢালাই করবার মানসিক প্রবণতা থেকে"।

ফের রক্তমাংসের ফুটবলে ফেরা যাক, এই বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচের চমক দেখেছিল সমগ্র মানবজাতির প্রায় এক চতুর্থাংশ। গতবারের চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্স নিজেদের পূর্বতন উপনিবেশ সেনেগালের কাছে হেরে গেল। সেনেগাল এবারই প্রথম বিশ্বকাপ খেলতে এসেছিল। সমস্ত ভবিষ্যৎবাণীকে ভুল প্রমাণ করে ফ্রান্স কোনও ম্যাচেই গোল করতে না পেরে প্রথম রাউন্ডেই ছিটকে গেল। অনেকে আরহেন্তিনার ওপর বাজি রেখেছিল, কিন্তু আরহেন্তিনারও একই হাল হলো। তারপর ইতালিয় আর হিস্পানিরা রেফারির মারে ব্যাগ গুছিয়ে ফেরত গেল। জেতার অবিরাম চাপ আর হারার ভয়- এই দুই যমজ ভাইয়ের চক্করে পড়ে এইসব বাঘা বাঘা দলগুলোর সর্বনাশ হলো। বিশ্বের সেরা তারকারা চ্যম্পিয়নশিপে এসেছিল খ্যাতি আর প্রত্যাশার পাহাড়প্রমাণ চাপ মাথায় নিয়ে। কিন্তু মাঠে নামার আগেই তারা নিজের নিজের ক্লাবের ওই মারাত্মক গতির ফুটবল খেলে খেলে ক্লান্ত, হতোদ্যম হয়ে পড়েছিল।

বিশ্বকাপের কোনও পূর্ব ইতিহাস ছাড়া, কোনও তথাকথিত তারকা ছাড়া, জেতার বাধ্যবাধকতা ছাড়া সেনেগাল শিল্পময় ফুটবল খেলে গেল। ওরাই এবারের কাপে সবচেয়ে বড় আবিষ্কার। চিন, ইকুয়েডর এবং স্লোভেনিয়াও এবারই প্রথম আগুনে হাত রাখল। কিন্তু তারা প্রথম রাউন্ডের বেড়া ডিঙোতে পারেনি। সেনেগাল অপরাজিত থেকে কোয়ার্টার ফাইনাল অবধি গেল কিন্তু তারপর আর এগুতে পারেনি। তবে ওদের কোমর দুলিয়ে অফুরান নাচ ফের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল যারা নিজেদের ফুটবল-বিজ্ঞানী বলে দাবি করে তারা আদতে কতটা মূর্খ। ওরা বোঝেই না, ফুটবল আসলে একটা খেলা। মানুষ ফুটবল খেলে আনন্দ পায়, আর যারা খেলা দেখে তাদেরও মন জুড়িয়ে যায়। আমার মতে, টুর্নামেন্টের সেরা গোলটা সেনেগালই করেছিল : চাও-এর [থিঅ] ব্যাক হিল থেকে বল পেয়ে ক্যামারা-র দুরন্ত শট। যে চ্যম্পিয়নশিপে চোখের আরামকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে বললেই ভালো, সেখানে সেনেগালের দিউফ প্রতি ম্যাচে গড়ে আটবার করে ড্রিবল করেছে।

তুরস্কও এবার চমকে দিয়েছে। তুরস্ক, ভাবা যায়! ওরা গত পঞ্চাশ বছরে বিশ্বকাপে সুযোগ পায়নি। ব্রাজিলের সঙ্গে নিজেদের প্রথম ম্যাচে রেফারির স্বেচ্ছাচারে তারা হারল ঠিকই, তবে তাদের স্বপ্নের দৌড় থামেনি। শেষমেশ তারা তৃতীয় স্থান পেয়েছিল। যেসব গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল সমালোচক চ্যাম্পিয়নশিপ শুরুর আগে তাদের হেলাফেলা করছিল, আবেগতপ্ত-দৃষ্টিনন্দন ফুটবলে তুরস্ক তাদের চুপ করিয়ে দিয়েছিল।

বিশ্বকাপের বাকি সময়টা আমি লম্বা লম্বা হাই তুলে গেছি। আমাদের কপাল ভালো যে ফাইনালের দিন ব্রাজ়িলের খেলোয়াড়দের মনে পড়েছিল তারা ব্রাজ়িলের হয়ে খেলছে। কোচ স্কোলারির মধ্যমমানের কেজো ফুটবল-দর্শনের খাঁচার তার কেটে তারা সেদিন সাচ্চা ব্রাজিল দলের মতো খেলেছিল। ব্রাজিলের চার ‘আর’- রোনাল্ডো (হোনাল্দো), রিভাল্ডো (হিবাল্দো), রোনাল্ডিনহো (হোনাল্দিনো), রোবের্তো কার্লোস (হোবের্তো কার্লোস) সেদিন ঝলসে উঠেছিল। ফলে ব্রাজিল আবার ফুটবল মাঠে উৎসবের মেজাজে ফেরে।

ব্রাজ়িল চ্যাম্পিয়ন হলো। ফাইনালের ঠিক আগেই সতেরো কোটি ব্রাজিলীয় কাঁটা-চামচে কেটে কেটে পুরুষ্টু জার্মান সসেজ সাঁটিয়েছিল। তার কিছুক্ষণ পরে জার্মানি ২-০ গোলে গোঁত্তা খেয়ে পড়ল। এবারের বিশ্বকাপে ব্রাজ়িল সাতটা ম্যাচ খেলে সাতটাই জিতল। দুই দলই বেশ কয়েকবার বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলেছে। কিন্তু তারা বিশ্বকাপে একে অপরের বিরুদ্ধে এই প্রথমবার খেলল। আগেই বলেছি তুরস্ক তৃতীয় হয়েছিল, দক্ষিণ কোরিয়া হলো চতুর্থ। এবার যদি বাজারের দিকে মুখ ফেরাই, নাইকি জিতল প্রথম আর চতুর্থ স্থান, আর অ্যাডিডাস দ্বিতীয় আর তৃতীয় স্থান।

ব্রাজ়িলের হোনাল্দো দীর্ঘ চোট-আঘাতের পর্ব সামলে মোট আটটা গোল করেছিল, তার সতীর্থ হিবাল্দো আর জার্মানির ক্লোজ়া পাঁচটা করে গোল করল। এদের পরেই চারটে করে গোল করে তালিকার তৃতীয় স্থানে ছিল ডেনমার্কের টমাসন আর ইতালির ভিয়েরি। তুরস্কের সুকুর খেলা শুরু এগারো সেকেন্ডের মাথায় গোল করে বিশ্বকাপের ইতিহাসে দ্রুততম গোলের রেকর্ড গড়ল।

বিশ্বকাপে প্রথমবার একজন গোলকিপার, জার্মানির অলিভার কান- টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হলো। বিপক্ষের বুকে সে এমন ত্রাস ছড়িয়েছিল যে লোকে বলাবলি করছিল অলিভার নাকি চেঙ্গিজ খানের ছেলে। কিন্তু কথাটা সত্যি নয়, বুঝতেই পারছেন!

আরও পড়ুন- এক হাতে রিভলবার, অন্য হাতে চিঠি! মাঝমাঠেই নিজেকে শেষ করে দিয়েছিলেন ফুটবলার

২০০৬-এর বিশ্বকাপ

আগের মতোই, সিআইএ নিজের মর্জিমাফিক পৃথিবীর এক দেশ থেকে অন্য দেশের জেলখানায় নিয়ে গিয়ে বন্দিদের ওপর অত্যাচার করবে বলে ইওরোপের আকাশে দিবারাত্রি বিমান চালিয়ে গেল। কাউকে বলা-কওয়া নেই, কারও অনুমতি নেওয়ার বালাই নেই, অভিবাদন কিংবা বিদায় সম্ভাষণ তো দূরের কথা। 

আগের মতোই, ইজ়রায়েল গাজ়ায় অনুপ্রবেশ করল। কীমাশ্চর্যম, তারা ফিলিস্তিনিদের হাতে বন্দি এক সৈনিককে উদ্ধার করতে গিয়ে বন্দুকের গনগনে আঁচে প্যালেস্তাইনের স্বাধীনতাকেই পণবন্দি করে রাখল।   

আগের মতোই, বিজ্ঞানীরা পৃথিবীর আবহাওয়া নিয়ে মানুষকে সতর্ক করে যাচ্ছিল, তাদের বক্তব্য খুব শিগগিরই মেরু অঞ্চলের বরফের মুকুট গলে গিয়ে সমুদ্রের জলস্তর এমন বাড়িয়ে দেবে যে সমুদ্র বন্দর থেকে শুরু করে বহু উপকূলীয় অঞ্চল ঢেউয়ে লুটোপুটি খেতে খেতে অচিরেই জলের নিচে তলিয়ে যাবে। যদিও বিজ্ঞানীদের কথায় কেউ কান দেয়নি। পরিবেশকে দূষিত করে আবহাওয়ার বারোটা বাজানোর ট্র্যাডিশন চলতেই থাকে।

আগের মতোই, মেহিকোর নির্বাচনে জালিয়াতির পাকা বন্দোবস্ত করা হলো। এবার দক্ষিণপন্থী দলের পদপ্রার্থীর এক শালা ভোট গণনার কম্পিউটারে এমন নিখুঁত প্রোগ্রামিং করে রেখেছিল যে তাদের বিশেষ চিন্তা করতে হয়নি।

আগের মতোই, মিয়ামির সর্বজ্ঞ মাতব্বররা বলে বেড়াচ্ছিল খুব শিগগিরই নাকি ফিদেল কাস্ত্রোর পতন অনিবার্য। আর সেরেফ কয়েক ঘণ্টার অপেক্ষা শুধু!
আগের মতোই, কুবায় মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে খবরের কাগজগুলোয় হেডলাইন তৈরি শুরু হয়ে গেল। ওদিকে গুয়ান্তানামোর মার্কিন সেনানিবাসে কয়েকশো বন্দির মধ্যে অন্তত তিনজনকে বিনা অপরাধে, বিনা বিচারে ফাঁসি দেওয়া হলো। হোয়াইট হাউস থেকে তার সাফাই দিতে গিয়ে বলা হলো সন্ত্রাসবাদীরা নাকি নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিতে এইসব করছে।

আগের মতোই, বলিভিয়ার রাষ্ট্রপতিকে ঘিরে কেচ্ছা শুরু হলো। ইভো মোরালেস ছিল সেদেশের প্রথম জনজাতিভুক্ত রাষ্ট্রপতি। বলিভিয়ার রাষ্ট্রপতি হয়ে সে দেশের তেল আর প্রাকৃতিক গ্যাসের খনিগুলোর রাষ্ট্রায়ত্বকরণ শুরু করে। সুতরাং বলতেই হয় মোরালেস দেশের মানুষকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি পূরণের মতো অমার্জনীয় অপরাধ করেছে।

আগের মতোই,  ইরাকে গণহত্যা চলতে থাকল। বেচারাদের একমাত্র দোষ হলো ওদেশের মাটির তলায় তেল আছে। আবার, ক্যালিফোর্নিয়ার প্যানডেমিক স্টুডিও একটা নতুন ভিডিও গেম বাজারে আনবে বলে ঘোষণা করল যেখানে খেলার নায়ক ভেনেজুয়েলা দখল করছে। ভুলে যাবেন না, ভেনেজুয়েলার মাটির তলাতেও অনেক তেল আছে।

মার্কিনিরা ইরান দখল করবে বলে শাসাচ্ছিল। আবার একটা দেশ বিপদে পড়ল যাদের মাটির তলায় প্রচুর তেল আছে। মার্কিনিদের যুক্তি ছিল ইরান পরমাণু বোমা বানানোর হুমকি দিচ্ছে। আমার ঠিক মনে পড়ছে না, আচ্ছা হিরোশিমা-নাগাসাকিতে কি ইরানই পরমাণু বোমা ফেলেছিল?

ওদিকে বাদামি রঙের দুষ্প্রাপ্য ভালুক ব্রুনোও আতঙ্ক ছড়াচ্ছিল। এতদিন ইতালিতে বন্দি থেকে সে এবার মুক্তি পেয়ে জার্মানির বনে জঙ্গলে নেচেকুঁদে বেড়াচ্ছিল। তার অবিশ্যি ফুটবলে কোনও আগ্রহই ছিল না। কিন্তু স্থিতাবস্থাপন্থীরা কোনও ছেলেমানুষি বরদাস্ত করতে চায় না। তারা অষ্টাদশ বিশ্বকাপ ফুটবল শুরুর ঠিক আগেই ব্রুনোকে বাভারিয়ার জঙ্গলে গুলি করে মারে। 

পাঁচটা মহাদেশ থেকে আসা বত্রিশটা দল ঐক্যবদ্ধ জার্মানির বারোটা সুসজ্জিত, সুপরিকল্পিত, রাজসিক স্টেডিয়ামে মোট চৌষট্টিটা ম্যাচ খেলল : স্টেডিয়ামগুলোর মধ্যে এগারোটা ছিল পূর্বতন পশ্চিম জার্মানিতে, আর পূর্ব জার্মানিতে মাত্রই একটা।

এই বিশ্বকাপের একটা থিম নির্দিষ্ট করা হয়েছিল। প্রতিটি ম্যাচের আগে খেলোয়াড়রা জাতপাতের ভেদবিভেদ এবং বর্ণবিদ্বেষের অসুখের বিরুদ্ধে একটা ব্যানার টাঙিয়ে মাঠে দাঁড়াত।

একটা নাড়া দিয়ে যাওয়ার মতো ঘটনা : ফরাসি রাজনীতিবিদ জঁ-মারি লে পেন হঠাৎ করে বলে বসল ফরাসিরা আদৌ তাদের জাতীয় ফুটবল দলে স্বদেশের মুখ দেখতে পাচ্ছে না, কেননা দলের বেশিরভাগ খেলোয়াড়ই কৃষ্ণাঙ্গ। বক্তব্যে আরও মশলা যোগ করে সে বলে দেয়, জ়িনেদিন জ়িদান নাকি যতটা আলজিরিয় ততটা ফরাসি নয়, এমনকী সে নাকি জাতীয় সুরেও গলা মেলাতে চায় না। ইতালির উপরাষ্ট্রপতি রোবের্তো ক্যালদেরোলি আরও একধাপ এগিয়ে বলে দিল, ফরাসি জাতীয় ফুটবল দলটা নাকি কৃষ্ণাঙ্গ, মুসলমান আর কমিউনিস্টদের ঠেক। তারা ‘লা মার্সেইয়েজ’ বদলে ‘ইন্টারন্যাশনাল’ গাইতে বেশি পছন্দ করে এবং বেথলেহেমের চাইতে মক্কাকে বেশি পবিত্র জ্ঞান করে। এর আগে হিস্পানি দলের কোচ লুইস আরাগোনেস ফরাসি তারকা থিয়েরি অঁরিকে ‘কালো গু’ বলে খিস্তি করেছিল। ওদিকে মান্ধাতার বাপের আমল থেকে দক্ষিণ আমেরিকায় ফুটবলের সর্বেসর্বা নিকোলাস লিয়োস তাঁর আত্মজীবনীর শুরুর পাতাতেই লিখেছিল সে নাকি জন্মেছে "এমন এক শহরে যেখানে মানুষ বলতে সাকুল্যে তিরিশজন ছিল, বাকিরা কয়েকশো আদিবাসী ইন্ডিয়ান।"

আরও পড়ুন- ফুটবলার না হোর্ডিং! জুতোর ফিতে বাঁধার নামে আসলে ব্র্যান্ড দেখাতেই চান খেলোয়াড়রা?

এবারের টুর্নামেন্টের একেবারে শেষ পর্যায়ে, কার্যত ফাইনাল ম্যাচের একেবারে শেষ মুহূর্তে কোত্থেকে মাঠে ষাঁড় ঢুকে পড়ল! জ়িদানের সেদিনই ফুটবলকে বিদায় জানিয়ে অবসর ঘোষণা করার কথা। গ্যালারিতে বসে বিপক্ষের সমর্থকেরা যেমন কাঁচা গাল দিয়ে উত্যক্ত করে, বিপক্ষের এক খেলোয়াড় তেমনই তাকে ক্রমাগত খোঁচাচ্ছিল, পালটা জ়িদান মাথা দিয়ে মারল এক ঢুঁসো। যে লোকটা বিরক্ত করছিল সে জ়িদানের ঢুঁসো খেয়ে চিৎ হয়ে পড়ল। আর জ়িদানকে রেফারি লাল কার্ড দেখাল। যে দর্শকরা আজ মাঠে এসেছিল শেষবার জ়িদানের  খেলা দেখবে বলে, তার বিদায়বেলায় হাততালি দেবে বলে, তারাই জ়িদানের আচরণে ছিছিক্কার করতে লাগল। জ়িদান চিরতরে মাঠ ছেড়ে বেরিয়ে গেল।

তাসত্ত্বেও, এটা জ়িদানেরই বিশ্বকাপ ছিল বলা যায়। শেষ ম্যাচে সে যাই করে থাক না কেন, টুর্নামেন্টে সেই ছিল সেরা খেলোয়াড়। তাছাড়া, ফাইনালে যে কাণ্ডটা সে ঘটায় সেটাকে পাগলামি হিসেবেও দেখা যায়, আবার চারিত্রিক দৃঢ়তা হিসেবেও দেখা যায়। আপনি কী চোখে দেখছেন তার ওপরই সবটা নির্ভর করছে। তার নজরকাড়া খেলা আর করুণসুরের সৌন্দর্যের কল্যাণে আমরা কিছুটা হলেও আশ্বস্ত ছিলাম যে ফুটবলটা একেবারে মধ্যমেধার তাঁবে চলে যায়নি। জ়িদানকে এজন্য অকুণ্ঠ ধন্যবাদ জানানো উচিত।

ফাইনাল ম্যাচে জ়িদানকে লাল কার্ড দেখানোর কিছুক্ষণ পরেই ইতালি পেনাল্টিতে ফ্রান্সকে হারিয়ে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হলো।

১৯৬৮ সাল পর্যন্ত খেলা অমীমাংসিত থাকলে একটা মুদ্রা শূন্যে ঘুরিয়ে খেলার মীমাংসা করা হতো। তারপর থেকে চলে আসছে পেনাল্টি শট নেওয়ার প্রথা। পেনাল্টিও কমবেশি ভাগ্যের ওপরেই নির্ভর করে। ফ্রান্স ইতালির চেয়ে ভালো দল ছিল, কিন্তু মাত্র কয়েক সেকেন্ডের পাকেচক্রে দু'ঘণ্টার চমৎকার খেলায় চোনা ফেলে দিল। একই ঘটনা ঘটেছিল আরহেন্তিনার সঙ্গেও। ওদের দল এবার জার্মানির চেয়ে ভালো ছিল, কিন্তু আরহেন্তিনাকেই আগে বাড়ি ফেরার বিমান ধরতে হলো। 

বার্লিনের ফাইনালে ইতালির জুভেন্টাস ক্লাবের আটজন খেলোয়াড় মাঠে নেমেছিল : পাঁচজন ইতালির হয়ে আর তিন জন ফ্রান্সের হয়ে। জুভেন্টাস বিশ্বকাপের আগে জালিয়াতির চক্করে গভীরভাবে জড়িয়েছিল। ইতালির ‘পরিচ্ছন্ন হাত’-এর স্লোগান শেষমেশ ‘পরিচ্ছন্ন পা’-য়ে রূপান্তরিত হয় : বিচারপতিরা জালিয়াতির যথেচ্ছ প্রমাণ পেয়েছিল। তার মধ্যে রেফারিকে ঘুষ দেওয়া, সাংবাদিককে পয়সা দিয়ে কিনে নেওয়া, চুক্তি নিয়ে জালিয়াতি করা, নিয়মকানুনকে বুড়ো আঙুল দেখানো, বড় পদের লোকজনকে জোচ্চুরিতে কাজে লাগানো, টিভি সম্প্রচারকে প্রভাবিত করা... সিলভিয়ো বার্লুসকোনির মিলানও ধোয়া তুলসী পাতা ছিল না। আর বার্লুসকোনি তো খলিফা লোক। ফুটবল, ব্যাবসা, এমনকী সরকারেও হাজারও জালিয়াতি করে দিব্যি তদন্ত এড়িয়ে বুক ফুলিয়ে ঘুরছিল। 

আরও পড়ুন- “জয় অথবা মৃত্যু”! বিশ্বকাপ ফাইনালের আগে ফুটবলারদের টেলিগ্রাম করলেন মুসোলিনি

ইতালি এই নিয়ে চতুর্থবার বিশ্বকাপ জিতল। ফ্রান্স হলো দ্বিতীয়। তারপরেই ছিল জার্মানি আর পর্তুগাল। আপনি বলতেই পারেন, পিউমা এবার অ্যাডিডাস আর নাইকিকে হারিয়ে দিল। পাঁচটা গোল করে মিরোস্লাভ ক্লোজ়া সর্বোচ্চ গোলদাতার পুরস্কার পেল। বিশ্বকাপ জেতায় দক্ষিণ আমেরিকা আর ইওরোপ সমান হয়ে গেল : দুই মহাদেশই ন' বার করে কাপ জিতল। ইতিহাসে এই প্রথম বার একই রেফারি, হোরাসিয়ো এলিসোন্দো, বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচ এবং ফাইনাল ম্যাচে গলায় বাঁশি ঝুলিয়ে মাঠে নামল। লোকটা প্রমাণও করেছে যে ওর চেয়ে ভালো আর কেউ ছিল না।

আর যা যা রেকর্ড হলো তা সবই ব্রাজিলিয়দের। হোনাল্দো ছেলেটা মোটাসোটা হলে কী হবে, যথেষ্টই কার্যকর ফুটবলার। সে বিশ্বকাপের ইতিহাসে সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়ে গেল। কাফু বিশ্বকাপে খেলে সবচেয়ে বেশি ম্যাচ জেতার রেকর্ড করে ফেলল। ব্রাজ়িল বিশ্বকাপে দল হিসেবে সবচেয়ে বেশি গোল করে ফেলল (মোট ২০১টা গোল)। এমনকী তারা পরপর এগারোটা ম্যাচ অপরাজিত থাকার রেকর্ডও করে ফেলল।

তবে ২০০৬-এর বিশ্বকাপে ব্রাজ়িল খেললেও তাদের উপস্থিতি আলাদা করে বোঝা যায়নি। মহাতারকা হোনাল্দিনো একটা গোলও করতে পারেনি, মাঠে তার কোনও জৌলুসই দেখা গেল না। ক্ষিপ্ত দর্শকেরা তার একটা বিশ ফুট লম্বা মূর্তি ভেঙে কাঠামোর ইস্পাত শুদ্ধ দুমড়ে-মুচড়ে ছাইয়ের গাদায় ফেলে দেয়। চ্যাম্পিয়নশিপের অন্তিম পর্বে বিশ্বকাপটা কার্যত ইউরো কাপ হয়ে উঠেছিল। লাতিন আমেরিকা, আফ্রিকা বা অন্য সব অ-ইওরোপিয় দেশ ততদিনে বাড়ি ফিরে গেছে।

কারও খেলাতেই খুব একটা কল্পনাশক্তির প্রয়োগ দেখা গেল না। ব্যতিক্রম শুধু ইকুয়েডর। চমৎকার খেললেও তারা অবিশ্যি খুব বেশিদূর এগুতে পারেনি। এবারের বিশ্বকাপকে একেবারেই নিরস বলা চলে। অপ্রত্যাশিত কিছুই ঘটেনি। একজন দর্শক বিশ্বকাপ শেষ হওয়ার পর বলেছিল, গোটা টুর্নামেন্টের নির্যাস ব্যাখ্যা করেছিল এভাবে : "এই বিশ্বকাপে খেলোয়াড়দের আচরণ নিয়ে কোনও কথা হবে না। তারা সিগারেট ফোঁকেনি, মদ গেলেনি, ফুটবলও খেলেনি"।  
ফুটবল থেকে শিল্পীরা সরে গিয়ে ভারত্তোলক আর অলিম্পিক দৌড়বাজদের জায়গা ছেড়ে দিয়েছে, যারা ক্রমাগত বল অথবা বিপক্ষকে লাথি মারে। 
এখনকার ফুটবলের কৌশলও সাধারণ জ্ঞানের মতো : প্রায় সবাই রক্ষণের খেলোয়াড়, কার্যত কোনও আক্রমণ ভাগ নেই। চিনের পাঁচিলের মতো গোল রক্ষক তিন কাঠির নীচে দাঁড়িয়ে সব শট প্রতিহত করবে। জঙ্গলে একা একজন শিকারি হয়তো হাপিত্যেশ করবে যদি একটা গোল করা যায়। এই কিছুদিন আগেও আক্রমণ ভাগে পাঁচজন খেলোয়াড় থাকত। এখন মাত্রই একজন। আর এভাবে চলতে থাকলে সবেধন নীলমণিটিও খুব বেশিদিন থাকবে না। 
আরহেন্তিনার প্রাণিবিদ্যাবিশারদ কার্টুনিস্ট রোবের্তো ফনতানারোসা এই বিশ্বকাপের একটা চমৎকার উপসংহার এঁকেছিল : সেই কার্টুনে স্ট্রাইকাররা পান্ডার মতো দেখতে। পান্ডারা যে প্রাণিজগতে বিপন্ন তা নিশ্চয় আপনাদের বলে দিতে হবে না।

More Articles