জমে গিয়েছে জলের পাইপ, কাঁপছে উত্তর ভারত, হঠাৎ করে কেন এমন শৈত্যপ্রবাহের দাপট?

Cold Wave in North India : কিন্তু কী এই শৈত্যপ্রবাহ? কেন এমন ঠাণ্ডার কামড় জাঁকিয়ে ধরেছে উত্তর ভারতকে?

তাপমাত্রা কোথাও ৭ ডিগ্রি, কোথাও নেমে গিয়েছে ৩-এ। কোথাও আবার পারদ নেমে গিয়েছে ০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। কাশ্মীরের ডাল লেকের একাংশ জমে গিয়েছে; পাইপ থেকে জল নয়, বেরোচ্ছে বরফের কুচি! বিগত কয়েকদিন ধরেই উত্তর ভারত কাঁপছে। দিল্লি থেকে মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান – শৈত্যপ্রবাহ একেবারে জাঁকিয়ে বসেছে। রাজস্থানের বিকানেরের তাপমাত্রা তো ০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের অঙ্ক ছুঁয়েছে! ওই রাজ্যেরই চুরুর তাপমাত্রা ১ ডিগ্রি। শীতের দাপট এমনই, সামান্য সোয়েটার আর লেপ কম্বলে হচ্ছে না। আগুন সেঁকার পরও শরীর জমিয়ে দিচ্ছে ঠাণ্ডা হাওয়া। ইতিমধ্যেই উত্তর ভারত জুড়ে শৈত্যপ্রবাহের দাপটে বেশ কয়েকজন মারাও গিয়েছে। বাড়ছে ব্রেন স্ট্রোক, কোল্ড স্ট্রোকের সম্ভাবনা।

উত্তর ভারত শৈত্যপ্রবাহে কাঁপলেও কলকাতায় সেভাবে দাপট ফেলেনি। ঠাণ্ডা হাওয়া ঢোকায় কাঁপুনির অনুভূতি হচ্ছে। কিন্তু এর আগে বাংলাও দেখেছে শৈত্যপ্রবাহের ঝোড়ো ইনিংস। কিন্তু কী এই শৈত্যপ্রবাহ? কেন এমন ঠাণ্ডার কামড় জাঁকিয়ে ধরেছে উত্তর ভারতকে?

কী এই কোল্ড ওয়েভ (Cold Wave) বা শৈত্যপ্রবাহ?

কেবল কোল্ড ওয়েভ নয়, তাপপ্রবাহ বা হিট ওয়েভের সঙ্গেও পরিচিত এই ভারত। গরম হোক বা শীত, সাধারণত ওই নির্দিষ্ট সময়ে তাপমাত্রা স্বাভাবিকের থেকে বেশ খানিকটা নিচে নেমে গেলে আবহাওয়া দফতর শৈত্যপ্রবাহ ঘোষণা করে। তবে সমস্ত জায়গার ক্ষেত্রে এই প্রবাহের মাত্রাটা একরকম নয়। পার্বত্য এলাকা, যেখানে এমনিতেই তাপমাত্রা কম থাকে, সেখানে যে পরিস্থিতিতে শৈত্যপ্রবাহ হবে, সমতলে সেটা হবে না। আইএমডি (IMD) বা ইন্ডিয়ান মেটেরোলজিকাল ডিপার্টমেন্টের মতে, উত্তর ভারতের সমতলের সর্বনিম্ন তাপমাত্রার গড় যখন ৪.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নামে তখন শৈত্যপ্রবাহ ঘোষণা করা হয়। তবে এর সঙ্গে সমতল অঞ্চলের দৈনিক গড় তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রির নিচে যেতে হবে।

আরও পড়ুন : এই কনকনে শীতে প্রাণ কাড়ছে কোল্ড স্ট্রোক! কোন উপসর্গগুলি দেখলেই সতর্ক হবেন?

এটা হল প্রাথমিক সীমারেখা। তাপমাত্রার পারদ এর থেকেও নিচে নামলে শৈত্যপ্রবাহের মাত্রা আরও ভয়ানক হবে। উত্তর ভারতের সমতল অঞ্চলের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা যদি ২ ডিগ্রি ছোঁয়, তবে ‘বিপজ্জনক শৈত্যপ্রবাহ’-র সংকেত দেওয়া হবে। এই মুহূর্তে এই দুটো পর্যায়ের মধ্যে দিয়েই চলছে উত্তর ভারত। কোথাও হলুদ সতর্কতা, কোথাও আবার কমলা সতর্কতা জারি করা হয়েছে।

হঠাৎ এরকম শৈত্যপ্রবাহের কারণ?

জায়গায় জায়গায় জমছে বরফ। মোটা জামাকাপড় পরলেও ঠাণ্ডা হাওয়া যেন চামড়া ভেদ করে ঢুকে যাচ্ছে। উত্তর ভারত জুড়ে দাপট দেখানো শৈত্যপ্রবাহের কারণ অবশ্য একটি নয়। বেশকিছু কারণ নির্ভর করে আছে।

চাপের তারতম্য ও জেট স্ট্রিম

ন্যাশনাল ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট এজেন্সি জানিয়েছে, এই মুহূর্তে উত্তর পশ্চিম এশিয়ায় একটি বিশেষ জলবায়ুগত ব্যাপার ঘটছে। সেটি হল জেট স্ট্রিম। ব্যাপারটি কী? বিশ্ব উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের খামখেয়ালিপনা পৃথিবীর সামগ্রিক স্বভাবের ওপর প্রভাব ফেলছে। এর ফলে পৃথিবী জুড়ে উষ্ণতার তারতম্য ঘটছে। কোথাও বেশি গরম, আবার কোথাও বেশি ঠাণ্ডা।

তাপমাত্রার এমন হেরফেরের জন্য চাপের তফাৎ হচ্ছে। ছোটবেলায় ভূগোলের পাঠ্যবইয়ে একটি ব্যাপার পড়েছিলাম সবাই। গরম বায়ু হালকা, তাই ওপরে ওঠে। অন্যদিকে, ঠাণ্ডা বায়ু ভারী; তাই নিচে থাকে। এই তাপমাত্রার হেরফেরের জন্য বাতাসও নিজের জায়গা বদল করে। ফলে চাপের তারতম্য দেখা যায়। আর এই তারতম্য একবার তৈরি হয়ে গেলে ঠাণ্ডা হাওয়া প্রবলভাবে গরম অঞ্চলের দিকে চলে আসবে। এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ঠাণ্ডা ও গরম বায়ুর এমন চলাচলই জেট স্ট্রিম। এই মুহূর্তে উত্তর ভারতের শৈত্যপ্রবাহের অন্যতম কারণ এটি।

আরও পড়ুন : কনকনে শীতেও গায়ে সামান্য হাফহাতা জামা, রাহুল গান্ধীর কি ঠাণ্ডা লাগে না? কী বলছেন বিজ্ঞানীরা?

মেঘ

আকাশে যত মেঘ থাকবে, তত গরম থাকে। মেঘ থাকা মানে আরও একটা স্তর তৈরি হয়ে যাওয়া। এর ফলে ইনফ্রারেড রশ্মি ও গরম ওই অঞ্চলের ভেতরেই ঘোরাফেরা করতে থাকে। সেজন্য শীতকালে মেঘ হলে ঠাণ্ডা ভাব কমে যায়, গরম বাড়ে। এই মুহূর্তে উত্তর ভারতের আকাশে সেরকম মেঘ নেই। ফলে সমতল থাকছে ঠাণ্ডা।

লা নিনা

ভূগোল নিয়ে যারা পড়াশোনা করেন, তাঁদের কাছে এই বিশেষ নামটি পরিচিত। মূলত প্রশান্ত মহাসাগরে এটি দেখা যায়। সমুদ্রে জলের উষ্ণতাও একরকম থাকে না। কখনও গরম, কখনও আবার ঠাণ্ডা। অনেক সময় গরম স্রোতের নিচে ঠাণ্ডা স্রোত থাকে। লা নিনার সময় এই গরম স্রোত চলে যায় ইন্দোনেশিয়ার দিকে। একবার সেই জল সরে যাওয়া মানে তলার ঠাণ্ডা জল ওপরে চলে আসা। ফলে সমুদ্র ঠাণ্ডা হবে; এবং জলের সংস্পর্শে থাকা বাতাসও ঠাণ্ডা হয়ে যাবে। গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো সেই হাওয়াও ঢুকবে স্থলভাগে। উত্তর ভারত এখন সেই ছবিটাই দেখছে।

আরও পড়ুন : রাজস্থানে অভাবনীয় তুষারপাত! কলকাতায় শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা?

এছাড়াও অসময়ে বৃষ্টিপাতও এমন শৈত্যপ্রবাহ তৈরি করতে পারে। এর থেকে বাঁচার উপায়, প্রয়োজন না হলে ঘরের বাইরে না বেরনো। যাদের শীতে কষ্ট হয়, তাঁরা পুরোপুরি ঘরের ভেতর হিটারের পাশে থাকবেন। শরীরের স্বাভাবিক তাপমাত্রা যদি কমে যায়, তাহলে হঠাৎ গুরুতর রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। সেখান থেকেই হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক। শরীর যেন ভিজে না থাকে, তাহলে ঠাণ্ডা আরও জাঁকিয়ে ধরবে। যদি বাইরে বেরতেই হয়, বেশ কয়েকটি জামা, শীতের মোজা পরে বেরনো উচিত।

More Articles