৩০০ জনেরও বেশি কিশোরীকে ধর্ষণ, খুন! এখনও বহাল তবিয়তে ঘুরে বেড়াচ্ছে এই সিরিয়াল কিলার
Pedro Lopez Monster of the Andes : এখনও অবধি ৩০০-র কাছাকাছি খুন করেছে সে। এবং এই মুহূর্তে, ২০২৩ সালে দাঁড়িয়ে, পেদ্রো লোপেজ কারাগার থেকে একেবারে মুক্ত।
১৯৯২ সাল। ইকুইডরের আমবাতো জেলের একটি কারাগারে মুখোমুখি বসে আছেন দু’জন। ইস্ত্রি করা, পরিপাটি করে চুল আঁচড়ানো ভদ্রলোকটির হাতে খাতা-পেনসিল এবং টেপ রেকর্ডার। এক ঝলক দেখেই মনে হচ্ছে, সাংবাদিক গোছের কেউ একজন হবেন। তাঁর ঠিক উল্টোদিকে বসে আছে আরও একজন। মুখ দেখলে আর পাঁচজনের মতোই সাধারণ মানুষ বলে মনে হয়। জীবনের ভার সেই মুখ আরও শক্তপোক্ত করেছে। এই কারাগার আসলে তার ঘরবাড়ি। রন লেইটনার নামের ওই ভদ্রলোকটির সামনে একেবারে ঠাণ্ডা দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে ওই লোকটি।
কথাবার্তা চলছিল ঠিকই। হঠাৎই এক জায়গায় এসে থমকে যান রন লেইটনার। পোড় খাওয়া চিত্র সাংবাদিক তিনি, কিন্তু সামনে বসে থাকা ওই মানুষটির মুখ থেকে যা শুনলেন, তারপর রাতে কি শান্তিতে ঘুমোতে পারবেন? টেপ রেকর্ডার একটু একটু করে নিজের তার গোটাচ্ছে। আর ভেসে আসছে সামনের ওই মানুষটা, ওই কয়েদির গলার শব্দ –
“কেউ আমাকে কোনওদিনও ভুলতে পারবে না। যখন ছোট্ট ওই কিশোরীদের গলা টিপে ধরি, মনে হয় সেটাই স্বর্গসুখ। সরাসরি ওদের চোখের দিকে তাকাই; দেখি, একটু একটু করে সেই চোখের আলো নিভে যাচ্ছে। যারা খুন করে, তারা জানে আমি কী বলছি। একদিন না একদিন তো আমি এই জেল থেকে ছাড়া পাব। তারপর আবার সেই মুহূর্তগুলোয় ফিরে যাব। আমার খুন করতে শুরু করব। এটাই আমাকে কানন্দ দেয়। এটাই আমার মিশন।”
এতখানি কথা বলে চুপ করল পেদ্রো লোপেজ। পরিচয়? পেদ্রো একজন কলম্বিয়ান। এবং, পেদ্রো বিশ্বের ভয়ংকরতম সিরিয়াল কিলারদের মধ্যে অন্যতম। যার ডাকনামই হয়ে গিয়েছিল ‘আন্দিজের রাক্ষস’। এখনও অবধি ৩০০-র কাছাকাছি খুন করেছে সে। এবং এই মুহূর্তে, ২০২৩ সালে দাঁড়িয়ে, পেদ্রো লোপেজ কারাগার থেকে মুক্ত। সে বেঁচে আছে, কিন্তু কোথায় আছে, সেটা কেউ জানে না…
আরও পড়ুন : পৃথিবীর সবচেয়ে কমবয়সি সিরিয়াল কিলার আছে ভারতেই! যে নৃশংসতায় হার মানবে সিনেমা
ছোটবেলার ভয়ংকর স্মৃতি
১৯৪৮ সাল। কলম্বিয়ার তোলিমায় জন্ম নেয় পেদ্রো লোপেজ। মা-বাবার সপ্তম সন্তান সে। বাড়িতে মোট ১৩ জন ভাইবোন। ছোটবেলায় বেশ শান্তশিষ্ট ভালমানুষটি ছিল পেদ্রো। স্বপ্ন দেখত, একদিন শিক্ষক হবে সে। ছাত্র পড়াবে, দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবে। যে ছেলের মনে ছোটবেলায় এমন চমৎকার স্বপ্ন খেলা করত, সে বড় হয়ে কী করে সিরিয়াল কিলার হতে পারে, জানা নেই। অবশ্য মনোবিদদের মতে, আসল রহস্য লুকিয়ে আছে এই ছোটবেলাতেই। বেশিরভাগ সিরিয়াল কিলারদের কপালের লিখন লেখা হয়ে যায় এই কিশোর বয়সে।
যে সময় পেদ্রোর জন্ম, তখন কলম্বিয়ার অবস্থা খুব একটা ভালো ছিল না। দেশের নানা জায়গায় গৃহযুদ্ধ চলছে। টাকাপয়সা নেই লোকের হাতে, চাকরি নেই। অদ্ভুত হিংস্র হয়ে উঠেছে সবাই। ১৩ জন সন্তানের দায়িত্ব সামলানো তো চাট্টিখানি কথা নয়! পরিস্থিতির সঙ্গে যুঝতে গিয়ে সমস্তটা ঘেঁটে গেল লোপেজ পরিবারে। পেদ্রো দেখত, ভাতের যোগান করতে তার মা দেহ ব্যবসায় নেমেছে। মায়ের ব্যবহারও অত্যন্ত রুঢ়, কঠোর। এই যাবতীয় পরিস্থিতিই একটু একটু করে তার শৈশব শেষ করে দিচ্ছিল। বদলে নিয়ে আসছিল এক হিংস্র প্রবৃত্তি।
এমন সময়ই অদ্ভুত একটি ঘটনা ঘটল। পেদ্রোর বয়স তখন আট বছর। হঠাৎই পেদ্রোর মা পেদ্রোকে নিজের ছোট বোনের সঙ্গে দেখতে পান। দেখেন, পেদ্রো জোর করে নিজের বোনের সঙ্গে যৌন সম্পর্কে লিপ্ত হতে চাইছে। সঙ্গে সঙ্গে রক্ত উঠে গেল মাথায়। এমনই ছিল শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন! এক মুহূর্ত দেরি না করে পেদ্রোকে বাড়ি থেকে বের করে দিলেন মা। ব্যস, এখান থেকে শুরু হল পেদ্রো লোপেজের জীবন।
আরও পড়ুন : কুমিরকে ভোগ দিয়ে লাশ লোপাট! ভারতীয় সিরিয়াল কিলার চিকিৎসকের গল্প হার মানাবে ক্রাইম থ্রিলারকে
রাস্তার জীবন
বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার পর রাস্তাই হল পেদ্রোর সঙ্গী। সেখানেই তার বসবাস, সামান্য খুঁটে খুঁটে যেটুকু খাবার খাওয়া। মা-বাবা বেঁচে থাকা সত্ত্বেও সে অনাথ, বাড়ি নেই খাবার নেই। সেই সময়ই এক ব্যক্তি তার দিকে এগিয়ে এল। পেদ্রোর হাত ধরে তাকে বলল, ভালো বাড়ি দেব। খাবার দেব। পেদ্রোকে সে তার বাড়ি নিয়ে যেতে চায়। কিশোর পেদ্রোর মনে হল, এ যেন কোনও দেবদূত। পরে সে বুঝতে পারবে, এ কোনও দৈব আশীর্বাদ নয়। বরং জীবনের কালো অধ্যায়ের সূত্রপাত।
রাস্তায় আলাপ হওয়া সেই মানুষটি পেদ্রোকে একটা ঘরে নিয়ে এল ঠিকই; কিন্তু সেটা তার নিজের বাড়ি নয়। একটা ভাঙাচোরা বাড়ি, যেখানে কেউ থাকে না, সেখানে পেদ্রোকে আটকে রাখল ওই লোকটা। দিনের পর দিন চলত অত্যাচার। শারীরিক, মানসিকের সঙ্গে চলত যৌন নিপীড়ন। বারংবার কিশোর পেদ্রোকে ধর্ষণ করত ওই লোকটি। একটা সময়ের পর তাকে আবার নিয়ে এসে ছুঁড়ে ফেলে দিল কলম্বিয়ার রাস্তার একটা কোণে। তারপর মানুষের ওপর থেকে বিশ্বাসটাই উঠে যায় পেদ্রোর। দিনের বেলায় কোনও অন্ধকার কোণে বসে থাকত সে। রাত গভীর হলে ডাস্টবিন ঘেঁটে খাবার খুঁজতে বেরত। এটাই হয়ে গিয়েছিল রুটিন।
এরপর ফের এক দম্পতি এগিয়ে আসেন তার জীবনে। তবে এবারের অভিজ্ঞতা আগের বারের মতো নয়। এই দম্পতি পেদ্রোর যাবতীয় দায়িত্ব নিতে রাজি হন। তাঁর খাবার, পোশাকের পাশাপাশি শিক্ষার দিকেও নজর দেন। শিক্ষা! আবারও ছোটবেলার স্বপ্ন জেগে উঠল পেদ্রো লোপেজের মনে। যদি এবার শিক্ষক হওয়া যায়!
আরও পড়ুন : ৬৫০ খুন করেছিলেন! পৃথিবীর প্রথম সিরিয়াল কিলারের গল্প হাড় হিম করে দেবে
কিন্তু জীবন তার কপালে হয়তো কেবল অন্ধকারই লিখে রেখেছিল। অনাথ বাচ্চাদের জন্য একটি স্কুলে ভর্তি হয় পেদ্রো। একদিন সেখানেই তাকে আটকে ধরে ওই স্কুলেরই এক শিক্ষক। ফের যৌন অত্যাচার, শারীরিক নির্যাতন… পুরনো ট্রমা ভর করে আসে। এরপর আর সেই ‘সভ্য’ জগতে ফিরে যায়নি পেদ্রো। ফের ছুটে আসে রাস্তায়। পড়াশোনা আর এগোয়নি; বরং রাস্তাঘাটে চুরি ছিনতাই করে দিন কাটে তার।
সেই চুরি করতে গিয়ে প্রথমবার পুলিসের নজরে আসে পেদ্রো লোপেজ। ১৯৬৯ সাল। সাত বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয় পেদ্রো। কিন্তু এখানেও ঘুরেফিরে আসে সেই পুরনো ট্রমা। জেলে ঢোকার দুদিনের মাথায় জেলের বেশ কয়েকজন বন্দি তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তাকে বারবার ধর্ষণ করে, অত্যাচার করে। শেষমেশ সহ্যের বাঁধ ভেঙে যায় পেদ্রো লোপেজের। লুকিয়ে রাখা ছুরি দিয়ে ওই চার কয়েদিকে কুপিয়ে হত্যা করে। জীবনের প্রথম খুন, হাতে-মুখে রক্ত ছিটকে এসে লাগল। আর সেটাই কাল হল। ১৯৭৮ সালে জেল থেকে মুক্ত হওয়ার পর শুরু হল পেদ্রো লোপেজের নতুন জীবন। জন্ম হল বিশ্বের অন্যতম কুখ্যাত সিরিয়াল কিলারের। জন্ম হল ‘দ্য মনস্টার অফ আন্দিজ’-এর।
সিরিয়াল কিলিং
১৯৮০ সাল। ইকুইডরের আমবাতো শহরের বাজারে টুকিটাকি কেনাকাটা করতে এসেছেন কারভিনা পোভেডা। সঙ্গে তার ১২ বছরের মেয়ে মারিয়া। দিব্যি চলছিল কেনাকাটা; হঠাৎই চিৎকার করে ওঠেন কারভিনা। তাঁর মেয়েকে তুলে নিয়ে একটা লোক দৌড়ে পালিয়ে যাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে আশেপাশের দোকানি, খদ্দেররা সচকিত হয়ে গেলেন। দৌড়ে গিয়ে ওই লোকটিকে ধরে ফেললেন সবাই। পুলিসও তড়িঘড়ি চলে এল। গ্রেফতার করা হল ওই লোকটিকে। নাম? পেদ্রো লোপেজ!
এবার ধরা পড়ার পর পুলিস তার যাবতীয় কাহিনি শোনে। তারপর অফিসারদের মুখ থেকে আর কথা সরেনি। তিনটি দেশ জুড়ে একের পর এক মানুষ খুন করে গিয়েছে পেদ্রো। নিজের দেশ কলম্বিয়ায় ১০০ জন, পেরু ও ইকুইডর মিলিয়ে অন্তত ২২০ জনকে মেরেছে সে! মানে, মোট ৩২০ জন! মাথা ঘুরতে আরম্ভ করে পুলিসের। শান্ত, ঠাণ্ডা গলায় পেদ্রো বলে চলে তার কীর্তি।
‘শিকার’ পাওয়ার জন্য সাধারণত বাজার এলাকা ও মার্কেটের আশেপাশে ঘুরঘুর করত পেদ্রো। তার শিকার মূলত কমবয়সী মেয়ে, কিশোরী, তরুণীরা। একবার শিকার খুঁজে নিলে, বেশ কয়েকদিন ধরে তাকে অনুসরণ করত পেদ্রো। তারপর সুযোগ বুঝে অপহরণ করে কোনও নিরিবিলি জায়গায় নিয়ে যেত। তারপর চলত সেই মেয়েটির ওপর অত্যাচার। মেয়েটিকে বারবার ধর্ষণ করত পেদ্রো, অত্যাচার করত; তারপর নিজের হাতে গলা টিপে মেরে দেহ পুঁতে দিত। বর্ণনা দেওয়ার সময় পেদ্রো বলত, একেবারে চোখে চোখ রেখে শিকারকে হত্যা করত সে।
আরও পড়ুন : স্তনবৃন্ত, কাটা জিভ দিয়ে বেল্ট, চেয়ার তৈরি- রাতের ঘুম কেড়েছে বীভৎসতম এই সিরিয়াল কিলাররা
কিন্তু তাই বলে ৩২০ জনকে খুন! আর পুলিস একবারও বুঝতে পারেনি! সেটা অবশ্য ঠিক নয়। কলম্বিয়ায় থাকার সময় রেড ইন্ডিয়ান মেয়েরাই ছিল তাঁর মূল টার্গেট। সেখানে ১০০-র ওপর খুন নাকি করেছে সে। কলম্বিয়ায় শেষ খুনটি করার সময় তাকে ধরে ফেলে রেড ইন্ডিয়ানরা। পরে পুলিসের হাতে দিয়ে দেওয়া হয় ও দেশ থেকে বিতাড়িত করা হয়। কিন্তু ৩২০ জনের দেহ কোথায় হাপিশ করা হয়েছে?
জবাব পেতে পেদ্রো পুলিসকে নিয়ে যায় আমবোতোর নিরিবিলি একটি জায়গায়। একটি বিশেষ অংশের দিকে আঙুল দেখায় সে। সেই জায়গা খোঁড়ার পর পুলিসের চক্ষু চড়কগাছ! একসঙ্গে ৫৩ জন মেয়ের কঙ্কাল পড়ে রয়েছে সেখানে! প্রত্যেকেরই বয়স ৮-১২ বছরের মধ্যে! বাকি দেহগুলি আর পাওয়া যায়নি। কিন্তু পেদ্রোর দাবি, খুনের সংখা অন্তত ৩২০!
শেষমেশ পেদ্রো লোপেজকে ইকুয়েডরের সর্বোচ্চ ১৬ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ব্যবহার ভালো করার জন্য মেয়াদ শেষের দুবছর আগে ১৯৯৪ সালে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। তারপর তিন বছর তার মানসিক রোগের চিকিৎসা চলে। তারপর ১৯৯৮ সালে পেদ্রো লোপেজকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
কিন্তু সাংবাদিককে দেওয়া তার ‘উক্তি’ এখনও ভোলেনি পুলিস। এই মুহূর্তে পেদ্রো লোপেজ জীবিত, কিন্তু কোথায় আছে কেউ জানে না। আবার সিরিয়াল কিলিং শুরু করেছে সে? সেটাও জানে না কেউ। কেবল তার হুমকি ঘুরে বেড়ায় কলম্বিয়ায়, ইকুয়েডরে। ঘুরে বেড়ায় তার অভিশপ্ত ছেলেবেলা। সেই তাড়নাতেই কি এতগুলো খুন? প্রতিশোধ সভ্যতার প্রতি? উত্তর নেই; রয়েছে কেবল, ভয়!