চিংড়ি খেতে গিয়ে এই মারাত্মক ভুল করছেন? জীবন নিয়ে টানাটানি হতে পারে যে কোনও সময়

Prawn Allergy: চিংড়িতে প্রোটিন প্রায় ৫৮-৬২%। ফ্যাটের পরিমাণও মাছ-মাংসের তুলনায় কম, মাত্র ৪-৬%। রক্তে যাদের কোলেস্টেরলের মাত্রা বেশি তারা পুষ্টিবিদের পরামর্শ নিয়ে তবেই চিংড়ি খান।

মাছের রানি ইলিশের গুণাগুণ প্রায় সকলেরই জানা। কিন্তু গুণী চিংড়িও কোনও অংশে কম যায় না। বাংলার সংস্কৃতির সঙ্গে রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে আছে চিংড়িও। নিখাদ ঘটিবাড়ি মানেই মোহনবাগান প্রেম আর বাড়িতে চিংড়ির সমারোহ। এছাড়া অন্য যে কোনও আমিষ জাতীয় খাবারের সঙ্গে টক্কর দিতে পারে চিংড়ি। চিংড়ি খেতে ভালবাসেন না এমন বাঙালি হাতে গোনা। বাজারে গেলেই হয় বাগদা নয় গলদা, আর তা না হলে কুচো চিংড়ি তো থাকবেই বাঙালির থলিতে।

চিংড়ি আসলে মাছ না কি পোকা- এ নিয়ে তর্ক রয়েছে, থাকবেও। তবে, চিংড়ির স্বাদ নিয়ে কারও দ্বিমত নেই। একদম ছোট গুঁড়ো চিংড়ি থেকে শুরু করে ইয়া বড় বড় চিংড়ি, সবই খেতে মুখরোচক। চিংড়ি দিয়ে বানানো যায় হাজারো মজাদার পদ, চিংড়ি মাছের কোর্মা, চিংড়ির বিরিয়ানি, লাউ চিংড়ি, কচুর লতি চিংড়ি, পুঁই চিংড়ির পকোড়া, দই চিংড়ি, ডাব চিংড়ি, চিংড়ি পিঁয়াজ, চিংড়ির চপ, চিংড়ি মাছের মালাইকারি, চিংড়ি ভর্তা, লিখে শেষ করা যাবে না। তবে জানলে অবাক হবেন, চিংড়ি কিন্তু কেবল আমাদের রসনা তৃপ্তিই ঘটায় না, একাধিক রোগে ওষুধ হিসাবেও কাজ করতে পারে।

চিংড়ি মাছ নাকি পোকা?

চিংড়ি হচ্ছে অর্থপোডা পর্বের সন্ধিপদযুক্ত অমেরুদণ্ডী প্রাণী। মাছ হিসাবে পরিগণিত হবে সেগুলোই যাদের মেরুদণ্ড ও পাখনা আছে এবং ফুলকার সাহায্যে শ্বাসকার্য চালায়। চিংড়ির মেরুদণ্ড নেই, এদের শ্বসন অঙ্গ প্রকৃত ফুলকার মতো নয় এবং এদের সন্ধিপদ যুক্ত পা আছে যা মাছের বৈশিষ্ট্য নয়। তাই চিংড়িকে মাছ বলা হয় না। জলের পোকা বলা হয়।

চিংড়ির পুষ্টিগুণ

চিংড়িতে প্রোটিন প্রায় ৫৮-৬২%। ফ্যাটের পরিমাণও মাছ-মাংসের তুলনায় কম, মাত্র ৪-৬%। রক্তে যাদের কোলেস্টেরলের মাত্রা বেশি তারা পুষ্টিবিদের পরামর্শ নিয়ে তবেই চিংড়ি খান। চিংড়ি সর্বদা রান্না করুন আনস্যাচুরেটেড তেলে যেমন সয়াবিন বা সানফ্লাওয়ার তেলে। এতে EAA ও EFA দু’টিরই পরিমাণ বেশ বেশি, যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে ও স্ট্রোক প্রতিরোধ করে। এতে রয়েছে প্রচুর মাত্রায় DHA, যা শিশুদের মস্তিষ্কের বিকাশে সহায়ক। এছাড়াও চিংড়ির শরীরে ধাতব পদার্থগুলির উপস্থিতি যেমন ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, পটাসিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, ফসফরাস, ও লোহা একে পুষ্টিগুণের দিক থেকে আরও সমৃদ্ধ করেছে।

চিংড়িতে রয়েছে সেলেনিয়াম, যা ইমিউনিটি থাইরয়েড ও রিপ্রোডাক্টিভ হেলথ ভালো রাখতে সাহায্য করে। ভিটামিন এ, ডি, ই, বি1, বি2, বি3 নার্ভাস সিস্টেম ভালো রাখে, ক্যালসিয়াম ও আয়রন ব্লাড ফরমেশন ও ক্লটিংয়ের জন্য বিশেষ দরকার।

আরও পড়ুন- খাসি বা ইলিশ নয়! ইছামতির গলদা চিংড়ি ভোগে সন্তুষ্ট কৃষ্ণচন্দ্রের সাধের ইটিন্ডার সিদ্ধেশ্বরী কালী

চিংড়ির পুষ্টি উপাদান

USDA-এর তথ্য মতে প্রতি ১০০ গ্রাম কাঁচা চিংড়িতে রয়েছে-

ক্যালোরি – ৮৫, টোটাল ফ্যাট – ০.৫ গ্রাম, কোলেস্টেরল - ১৬১ মিলিগ্রাম, সোডিয়াম - ১১৯ মিলিগ্রাম, পটাশিয়াম – ২৬৪ মিলিগ্রাম, টোটাল কার্বোহাইড্রেট – ০ গ্রাম, প্রোটিন – ২০ গ্রাম, আয়রন - ২%, ক্যালসিয়াম - ৬%, ম্যাগনেসিয়াম - ৮%

আবার, USDA এর তথ্য মতে, প্রতি ১০০ গ্রাম রান্না করা চিংড়ি থেকে পাওয়া যায়-

ক্যালোরি – ৯৯, টোটাল ফ্যাট – ০.৩ গ্রাম, কোলেস্টেরল - ১৮৯ মিলিগ্রাম, সোডিয়াম - ১১১ মিলিগ্রাম, পটাশিয়াম – ২৫৯ মিলিগ্রাম, টোটাল কার্বোহাইড্রেট - ০.২ গ্রাম, প্রোটিন – ২৪ গ্রাম, আয়রন - ২%, ক্যালসিয়াম – ৭%, ম্যাগনেসিয়াম - ৯%

চিংড়ি মাছের উপকারিতা

১. শরীরে ভাল কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়ায় চিংড়ি। চিংড়ির মধ্যে থাকে এমন কিছু উপাদান যা ক্ষতিকারক হোমোসিস্টাইন অনুগুলিকে ধ্বংস করে দেয়। সেই সঙ্গে শরীরে ওমেগা-৬ এবং ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিডের পরিমাণও রাখে নিয়ন্ত্রণে।

২. চিংড়ির মধ্যে থাকে সেলেনিয়াম। যা ক্যান্সার কোশ গঠনে বাধা দেয়। সেই সঙ্গে থাকে গ্লুটাথিয়ন পারক্সিডেজ- যার মধ্যে অ্যান্টি-কার্সিনোজেনিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এই উপাদান বিপাকক্রিয়া স্বাভাবিক করে এবং কোলোরেক্টাল ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়।

৩. যারা শারীরিক দুর্বলতায় ভোগেন তারা বেশি বেশি চিংড়ি খেতে পারেন। চিংড়ি শরীরের প্রায় ১৭ শতাংশ আয়রনের ঘাটতি পূরণ করায় সহযোগিতা করে। ফলে শারীরিক দুর্বলতা কেটে গিয়ে শক্তি বৃদ্ধি পায়।

৪. চিংড়িতে আছে প্রায় ১৪ শতাংশ ফসফরাস। ফলে চিংড়ি খেলে হাড়ের ক্ষয় রোধ হওয়ার পাশাপাশি হাড় হয় মজবুত ও শক্ত।

৫. চিংড়ি মানব শরীরের ভিটামিন বি১২-এর চাহিদা দূর করে। পাশাপাশি রক্তের হিমোগ্লোবিনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। তাই রক্তস্বল্পতায় ভোগা ব্যক্তিরা চিংড়ি খেলে উপকার পাবেন।

৬. বিষণ্ণতায় ভোগা ব্যক্তিরা চিংড়ি খেলে বিষণ্ণতা দূর হয়। কারণ এতে আছে ৩৪৭ মিলিগ্রাম ওমেগা৩ ফ্যাটি অ্যাসিড। এটি মস্তিষ্কে সেরেটেনিন উৎপন্ন করে এবং বিষণ্ণতা দূরীকরণে ভূমিকা রাখে।

৭. ডায়াবেটিসের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যও চিংড়ি খেতে পারেন। কারণ চিংড়িতে থাকা ম্যাগনেশিয়াম দেহকে টাইপ-২ ডায়বেটিসের হাত থেকে রক্ষা করে।

৮. যাদের মোটা হয়ে যাওয়ার ভয় আছে তারা নির্দ্বিধায় চিংড়ি খান। চিংড়ি শরীরে ফ্যাট জমতে বাধা দেয়। আমাদের শরীরের প্রয়োজনীয় প্রোটিনের চাহিদার প্রায় ৪২ শতাংশ চিংড়ি পূরণ করতে সক্ষম। আর শরীরে পর্যাপ্ত প্রোটিন থাকলে ত্বক, চুল এবং নখ ইত্যাদি থাকে সুরক্ষিত।

চিংড়ি মাছের অপকারিতা

গরম ভাতে কচুশাক চিংড়ি হোক বা মালাইকারি খেতে তো বেশ লাগে, কিন্তু এই পাত চেটেপুটে খাওয়ার পর শরীরে কতখানি ক্যালোরি গেল তার হিসেব রাখেন কি? সামুদ্রিক মাছের মধ্যে থাকে প্রচুর পরিমাণ পুষ্টি। থাকে ক্যালশিয়াম, ওমেগা-৩, ভিটামিন, আয়রন এবং স্যাচুরেটেড ফ্যাট। আর তাই কম পরিমাণে খেলেই পেট ভরে যায়। যে কারণে যাঁরা ডায়েট করছেন বা ওজন কমানোর চেষ্টা করছেন তাদের চিংড়ি খেতে মানা করা হয়। বিশেষত বড় চিংড়ি। এই চিংড়ির মধ্যে ক্যালোরির পরিমাণ সব চাইতে বেশি থাকে। চিংড়ির খোসায় থাকে অ্যাটাক্সানথিন, যা খেতে ভাল। কিন্তু এই পদার্থটিই চিংড়ির মধ্যে ফ্যাটের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। তবে চিংড়ি কিন্তু ভিটামিন ডি-এর ভালো উৎস। এই ভিটামিন ডি ক্যালশিয়াম ও ফসফরাস শোষণ করে। ফলে রক্তে এই দু’টি উপাদানের মধ্যে ভারসাম্য বজায় থাকে।

কেন চিংড়ি ওজন বাড়ায়

চিংড়ি মাছের মধ্যে ক্যালোরির পরিমাণ বেশি থাকে। তবে চিনি এবং চর্বি কিন্তু থাকে না। এছাড়াও থাকে ভিটামিন বি ১২। সেই সঙ্গে রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা বজায় রাখতেও সাহায্য করে চিংড়ি। ত্বক আর চুলও ভাল রাখে। চিংড়ি খেলে তখনই ওজন কমে যদি তা স্টিম বা সিদ্ধ করে খাওয়া হয়। আদা-পেঁয়াজ-রসুন মশলা দিয়ে চিংড়ি রান্না করলেই ওজন বাড়ে। দিনে ১০০ গ্রামের বেশি চিংড়ি একেবারেই খাবেন না। আলু, লেবু আর ভুট্টা বাদ দিয়ে চিংড়ি রান্না করুন। চিংড়ির সঙ্গে এই উপাদানগুলো মিশলে তাতে ফ্যাটের পরিমাণ বেড়ে যায় আরও খানিকটা। যাঁদের থাইরয়েডের সমস্যা রয়েছে, লিভারের সমস্যা রয়েছে তাঁদের কিন্তু একেবারেই চিংড়ি খাওয়া ঠিক নয়। তাই ডায়েটে চিংড়ি রাখলে অবশ্যই পুষ্টিবিদের পরামর্শ নিয়ে নেবেন।

চিংড়িতে উচ্চমাত্রার কোলেস্টেরল থাকে। অন্যান্য ধরনের সামুদ্রিক খাবারে কোলেস্টেরলের পরিমাণের চেয়ে প্রায় ৮৫% বেশি। উচ্চ কোলেস্টেরলযুক্ত খাবারগুলি আপনার রক্তে কোলেস্টেরল এবং হৃদরোগ বাড়ায়। রক্তের বেশিরভাগ কোলেস্টেরল আপনার লিভার দ্বারা উৎপাদিত হয় এবং আপনি যখন উচ্চ কোলেস্টেরল খাবার খান, তখন লিভার কম উৎপাদন করে।

আরও পড়ুন- ইলিশের পেটে বালি, পাল্টে যাচ্ছে স্বাদ! বাঙালির প্রিয় মাছ বয়ে আনছে দুঃসংবাদ

অ্যালার্জি থেকে সাবধান

যতটা চটজলদি চিংড়ি মাছ রান্না করা যায়, এই মাছ পরিষ্কার করাটা ততটাই ঝক্কির! অনেকেই এই ঝক্কি এড়াতে মাছ বিক্রেতাদের কাছ থেকেই চিংড়িমাছ পরিষ্কার করিয়ে আনেন। অনেকেই চিংড়ির গায়ে লেগে থাকা কালো শিরা ফেলেন না, আর তাতেই হয় সমস্যা।

চিংড়ি মাছের খোলসের নীচে এই কালো শিরায় শরীরের নানা বর্জ্য পদার্থগুলি জমা থাকে। এই শিরাটি ভাল ভাবে পরিষ্কার না করে এই মাছ খেলে আপনার অ্যালার্জির সমস্যা হতে পারে, শুধু তাই নয়, এর ফলে শরীরের মারাত্মক ক্ষতিও হতে পারে।

ঠিক কী কী সমস্যা হয় শিরা-যুক্ত চিংড়ি খেলে?

চিকিৎসকদের মতে, আপনার যদি চিংড়ি থেকে অ্যালার্জির সমস্যা না থাকে তা হলে শিরা-যুক্ত চিংড়ি খেলে আপনার অ্যালার্জি হবে না। তবে এই শিরা খেলে আপানার পেটের গণ্ডগোল ও বদহজমের সমস্যা হতেই পারে। আর যাঁদের অ্যালার্জির সমস্যা আছে, তাঁরা শিরা-যুক্ত মাছ খেলে শরীরে প্রদাহ তৈরি হয়। শ্বাসনালির পেশির সংকোচন বেড়ে যায়। রক্তনালিগুলি ফুলে ওঠে। চিকিৎসার পরিভাষায় এর নাম ভ্যাসোডাইলেশন। যথেষ্ট পরিমাণ রক্ত আর হৃদযন্ত্রে পৌঁছয় না। মস্তিষ্কেও রক্ত পৌঁছানোর পরিমাণ কমতে থাকে। ফলে গলা ধরে যাওয়া, নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হওয়ার মতো সমস্যা হয়। এমনকী, এর জেরে মৃত্যুও হতে পারে।

তবে চিংড়িতে উপস্থিত রয়েছে বেশ কয়েকটা অ্যালার্জিক যৌগ যেমন ট্রোপোমায়সিন, আর্জিনিন কাইনেজ ইত্যাদি, যা আমাদের দেহে বিভিন্ন রকম সমস্যা তৈরি করতে পারে যেমন, ত্বকের প্রদাহ, শ্বাসকষ্ট, চোখের সমস্যা ইত্যাদি। এর মারাত্মক আকার দেখা যায় অনাফেলাইটিক শক হিসাবে, যা অত্যন্ত সঙ্কটজনক পরিস্থিতি তৈরি করে। তবে এটি খুবই কম ক্ষেত্রেই হয়ে থাকে।

তাই ইলিশের তেল-ঝাল হোক বা চিংড়ির মালাইকারি, পাতে থাকতেই পারে! তবে ডায়াবেটিস, কিডনি, ডিসলিপিডমিয়া ইত্যাদির সমস্যা থাকলে অবশ্যই পুষ্টিবিদের পরামর্শ নিয়ে তবেই খান। দেখবেন পেট মন দুইই ভালো থাকবে।

More Articles