মুরগির মাংস খেলেই ম্যাচে হার! ফুটবলের বিচিত্র কুসংস্কারের এই ইতিহাস অজানাই

Superstitions of Football: মাঠে ঢোকার সময় অনেক খেলোয়াড়ই ডান পা-টা আগে বাড়ায়। অনেকে মাঠে ঢুকে সোজা ফাঁকা গোলের সামনে গিয়ে একটা শট নেয়, কিংবা বারপোস্টে চুমু খায়।

১৯৩৪-এর বিশ্বকাপ

জনি ওয়াইজ়মুলার তখন প্রেক্ষাগৃহে তোলপাড় তুলছে টারজ়ানের সেই বিখ্যাত আর্তনাদে, আম-আদমির ব্যবহারের জন্য প্রথমবার বাজারে ডিওডোরেন্ট আসতে চলেছে, লুইজ়িয়ানার পুলিশ গুলিবৃষ্টি করে নিকেশ করেছে বনি আর ক্লাইড- খতরনাক সেই তস্কর জুটিকে। দক্ষিণ আমেরিকার দরিদ্রতম দুই দেশ বলিভিয়া আর প্যারাগুয়ে স্ট্যান্ডার্ড অয়েল আর শেল কোম্পানির বকলমায় মূর্খের মতো গ্র্যান-চাকো এলাকায় যুদ্ধ করে রক্তবন্যা বইয়ে চলেছে। নিকারাগুয়ায় সানদিনো মার্কিন নৌ-বহরকে রুখে দিলেও নিজে গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গেলেন। সানদিনোর হত্যাকারী সোমোসা অনতিবিলম্বেই নিজের সাম্রাজ্য স্থাপনে তৎপর হয়ে উঠল। চিনে মাও লং মার্চ শুরু করবেন। থার্ড রাইখে হিটলার ফুয়েরায়ের মুকুট মাথায় পরেই খাঁটি আর্যত্ব রক্ষা করতে আইন জারি করা শুরু করেছে, অপরাধীদের আর বংশগত অসুখে ভুগছে যারা, তাদের জোর করে নির্বীজকরণ শুরু হয়েছে। ওদিকে ইতালিতে মুসোলিনি দ্বিতীয় বিশ্বকাপ উদ্বোধন করছে।

দ্বিতীয় বিশ্বকাপের পোস্টারটাও ছিল অভিনব! হারকিউলিস এক পায়ে বল নিয়ে ভারসাম্য বজায় রাখতে রাখতেই ডান হাত তুলে ফ্যাসিস্ত কায়দায় স্যালুট করছিল। ‘ইল দুচে’ মুসোলিনির কাছে ’৩৪-এর বিশ্বকাপ ছিল বৃহত্তর প্রচারের মঞ্চ। সে সব ক'টা ম্যাচেই গ্যালারিতে এসে থুতনি তুলে রাজকীয়ভাবে বসে থাকত, আর মাঠের যেদিকেই চোখ পড়ত ব্ল্যাক শার্ট বাহিনীতে ছয়লাপ হয়ে থাকত গোটা স্টেডিয়াম। ইতালি দলের এগারোজন খেলোয়াড় একটা করে ম্যাচ জিতে উঠে মাঠের ধারে সটান মুসোলিনির সামনে হাজির হত এবং ডান হাত বাড়িয়ে তাঁকে বাধ্যতামূলক অভিবাদন জানিয়ে নিজেদের জয় উৎসর্গ করত।
তবে ইতালির পক্ষে খেতাব জেতার রাস্তা খুব মসৃণ ছিল না। সেমিফাইনালে ইতালির সঙ্গে হিস্পানি দেশের খেলাটাই বিশ্বকাপের ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘ আর ক্লান্তিকর ম্যাচ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। যুদ্ধটা চলেছিল ২১০ মিনিট ধরে এবং প্রথম দিন কোনও মীমাংসা না-হওয়ায় খেলা গড়ায় পরের দিনে। ইতালি জেতে। কিন্তু শুরুতে যে দল নিয়ে তারা নেমেছিল শেষ পর্যন্ত তার মধ্যে চারজনকে বসে যেতে হয়, হিস্পানিরা বাধ্য হয় সাতজনকে বসিয়ে দিতে, দু'দলের মোট এগারোজন খেলোয়াড় যুদ্ধের ক্ষত-আঘাত শরীরে নিয়ে ক্লান্তিতে ভেঙে পড়ে সাইডলাইনের ওপারে গিয়ে ঘাসের উপরেই লুটিয়ে যায়। দুই নামজাদা হিস্পানি যোদ্ধা ল্যাঙ্গারা আর গোলকিপার সামোরা, যাঁদের দিকে দর্শকেরা সম্মোহিতের মতো চেয়ে থাকত, তারাও মাঠ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল।

জাতীয় ফ্যাসিস্ত পার্টি স্টেডিয়ামে ফাইনালের দিন চেকোস্লোভাকিয়াকে ২-১ গোলে হারিয়ে ইতালি সেবার চ্যাম্পিয়ন হয়। সদ্য ইতালির নাগরিকত্ব নেওয়া দুই আরহেন্তিনীয় নিজেদের দায়িত্বটুকু চমৎকার উৎরে দিয়েছিল। গোলকিপারকে নিখুঁত কাটিয়ে ওরসি প্রথম গোলটা করে, অন্য আরহেন্তিনীয় গোআইতার সাজানো পাস থেকে গোল করে স্কিয়াভো ইতালিকে কাপ এনে দেয়।

’৩৪-এর বিশ্বকাপে মোট ষোলটা দল খেলেছিল; ইওরোপ থেকে বারোটা দেশ আর লাতিন আমেরিকার তিনটে, তামাম দুনিয়ার বাকি মহাদেশগুলি থেকে একমাত্র প্রতিনিধিত্ব করেছিল মিশর। গতবারের বিশ্বকাপজয়ী উরুগুয়ে ১৯৩৪-এর বিশ্বকাপ খেলতে যাবার আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করে, কেননা ইতালি এর আগেরবার প্রথম বিশ্বকাপ খেলতে মন্তেভেদিয়ো যায়নি।

জার্মানি আর অস্ট্রিয়া যথাক্রমে তৃতীয় আর চতুর্থ হয়। চেকশ্লোভাকিয়ার নেড্‌লি পাঁচটা গোল করে সেরা গোলদাতার পুরস্কার পায়। তারপরেই ছিল জার্মানির কোহেন আর ইতালির স্কিয়াভো, দু'জনেই চারটে করে গোল করেছিল।

আরও পড়ুন- উড়ন্ত গোল করতে করতেই মারাত্মক সংঘর্ষ, বাইসাইকেল কিক কেড়েছিল ফুটবলারের প্রাণ

হিউ দে জেনেইরোর ঈশ্বর আর শয়তান

১৯৩৭ সালের আয়ু তখন প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। সেদিন রাতে যখন অঝোরে বৃষ্টির পড়ছে, প্রতিপক্ষ দলের এক অন্ধভক্ত ভাস্কো দা গামা ক্লাবের মাঠে একটা ব্যাঙের মুখ সেলাই করে মাটিতে পুঁতে অভিশাপ দিয়ে আসে, "যদি সত্যিই ঈশ্বর থেকে থাকেন, তাহলে আগামী ১২ বছর ভাস্কো আর কিছুতেই চ্যাম্পিয়ন হবে না"। আরুবিনিয়া নামের সেই লোকটি আসলে একটি প্রবল বিনয়ী আর নড়বড়ে দলের সমর্থক ছিল, ভাস্কো যাদের সদ্যই ১২-০ গোলে হারিয়েছিল।

তারপরে বহু বছর যাবৎ ভাস্কোর ভক্তরা, এমনকী খেলোয়াড়রাও সেই মাটি-চাপা দেওয়া ব্যাঙটিকে মাঠ জুড়ে হন্যে হয়ে খুঁজেছে, কিন্তু কিছুতেই খুঁজে পায়নি। এই করতে গিয়ে খেলার মাঠটাকে খুঁচিয়ে-খুঁচিয়ে তারা এমন খোঁদল করে ফেলেছিল যে মাঠের দিকে তাকালে চাঁদের কলঙ্কের কথা মনে পড়ত। ভাস্কো দা গামা ব্রাজ়িলের সেরা খেলোয়াড়দের দলে নিয়েছে, ভালো ভালো দলগুলোকেই আস্ত কিনে ফেলেছে তবু হারের ধারা অব্যাহতই থাকে।
শেষ পর্যন্ত ১৯৪৫-এ ভাস্কো হিউ-কাপ জিতলে শাপমোচন হয়। ১৯৩৪ সালের পর সেই প্রথম তারা জিতল। এগারো বছরের খরা কাটার পর ক্লাবের সভাপতি মজা করে মন্তব্য করেন, "ঈশ্বর আমাদের সামান্য হলেও ছাড় দিয়েছেন"।

এর অনেক পরে ১৯৫৩-য় ফ্ল্যামেঙ্গোর মতো ক্লাবও এই রকমই একটা সমস্যায় ভুগছিল। ফ্ল্যামেঙ্গো তো আর এলিতেলি কোনও ক্লাব নয়, শুধু হিউ দে জেনেইরোতেই নয়, গোটা ব্রাজ়িলেই জনপ্রিয়তম। ব্রাজ়িলের যেকোনও শহরেই ম্যাচ হোক না কেন, তারাই একমাত্র ক্লাব যারা সব সময়ই তারা হোমম্যাচ খেলার মতো দর্শকানুকূল্য পায়। ফ্ল্যামেঙ্গোর মতো এত বেশি সমর্থক আর কোনও ক্লাবের নেই, চিরকাল উল্লাসে অভ্যস্ত সেই বিপুল জনতা তখন হারতে হারতে একেবারে দমে গিয়েছিল। এমন সময় ফাদার গোজ় নামে এক ক্যাথলিক যাজক নিশ্চিত জয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসরে অবতীর্ণ হন। ফাদারের বক্তব্য ছিল দলের খেলোয়াড়রা তাঁর দেখানো পথে চললেই মাঠে জয় নিশ্চিত। শুধু প্রত্যেকটা ম্যাচের আগে ফাদারের সঙ্গে গির্জায় গিয়ে জপমালা হাতে অল্টারের সামনে হাঁটু মুড়ে বসে প্রার্থনা করতে হবে।

ফাদারের কথা মতো চলেই ফ্ল্যামেঙ্গো পরপর তিনবার কাপ জিতল। তখন অন্য দলগুলো কার্ডিনাল জাইমে কামারার কাছে নালিশ ঠুকল; ফ্ল্যামেঙ্গো বেআইনি কাজ করছে। ফাদার গোজ় আত্মপক্ষ সমর্থনে বলেন, তিনি কেবলই খেলোয়াড়দের ঈশ্বরের কাঙ্ক্ষিত পথে পরিচালিত করেছেন, তার বেশি কিছু নয়। ফ্ল্যামেঙ্গোর খেলোয়াড়রা লাল-কালো পুঁতির জপমালা হাতে প্রার্থনা চালিয়েই যায়। এদিকে লাল-কালো রং তো শুধু ফ্ল্যামেঙ্গোর রংই নয়, আফ্রিকার এক দেবতারও যিনি একই অঙ্গে যিশু আর শয়তান। চতুর্থ বছরে ফ্ল্যামেঙ্গো হেরে যাওয়ায় খেলোয়াড়রা ফাদারের কাছে যাওয়া বন্ধ করে দিল, তারা আর জপমালা ছুঁয়েও দেখে না, প্রার্থনাও বন্ধ করে দেয়। ফাদার গোজ় মহামহিম পোপের কাছে সাহায্য চেয়ে বার্তা পাঠালেন, যদিও প্রভু কোনওদিন তার উত্তর দেননি।

অন্যদিকে ফাদার রোমুআলদো ফ্লুমিনেন্স ক্লাবের সঙ্গে জড়াবার আগে পোপের অনুমতি আদায় করেছিলেন। এই যাজক আবার প্রতিদিন দলের অনুশীলনে হাজির থাকতেন। খেলোয়াড়রা ব্যাপারটা একেবারেই পছন্দ করত না। ফ্লুমিনেন্স পাক্কা ১২ বছর আগে শেষবার হিউ-কাপ জিতেছিল। খেলোয়াড়রা জানত মাঠের ধারে অমন একটা কালো রঙের ধেড়ে লোক দাঁড়িয়ে থাকাটা অত্যন্ত অমঙ্গলজনক, ব্যাটা অনামুখো ওখানে দাঁড়ায় কোন আক্কেলে! তাই ক্লাবের সমস্ত খেলোয়াড় চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে ফাদারের উদ্দেশে বাছাই করা খিস্তি উগড়ে দিত। কিন্তু তারা জানত না যে ফাদার রোমুআলদো জন্ম থেকেই বদ্ধ কালা।

এক সময় ফ্লুমিনেন্স সত্যি সত্যি জিততে শুরু করল। তারা একটা কাপ জিতল, তারপর আরেকটা, তারপর আরও একটা। তখন ফ্লুমিনেন্সের ফুটবলাররা যতক্ষণ-না মাঠে ফাদার রোমুআলদোর বিশাল বপুর ছায়া পড়ছে, ততক্ষণ অনুশীলন শুরু করত না। প্রতিটি গোলের পর তারা ফাদারের জোব্বাটায় চুমু খেয়ে আসত। শনি-রোববার ফাদার গিয়ে বসতেন স্টেডিয়ামের রাজকীয় আসনে। যতক্ষণ খেলা চলত ফাদার নাগাড়ে বিড়বিড় করে রেফারি আর প্রতিপক্ষকে শাপমন্যি করে যেতেন।

আরও পড়ুন- এক হাতে রিভলবার, অন্য হাতে চিঠি! মাঝমাঠেই নিজেকে শেষ করে দিয়েছিলেন ফুটবলার

দুর্ভাগ্যের শেকড়-বাকড়

একথা তো সবাই জানে যে ব্যাঙ মাড়িয়ে যাওয়া কিংবা গাছের ছায়ার উপর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার মতো অমঙ্গুলে কাণ্ড আর হয় না। মইয়ের তলা দিয়ে হেঁটে যাওয়া কিংবা উলটো মুখে বসা বা ঘুমোনো, ঘরের মধ্যে ছাতা খোলা, নিজের দু'পাটিতে কতগুলো দাঁত আছে গোনা কিংবা আয়না ভেঙে ফেলা সবই জীবনে অভিশাপ বয়ে আনে। কিন্তু ফুটবলে এসব ব্যাপার কোনও দাগ কাটে না।

আরহেন্তিনার ১৯৮৬ আর ১৯৯০ বিশ্বকাপ দলের কোচ কার্লোস বিলার্দো দলের ছেলেদের কিছুতেই মুরগির মাংস খেতে দিত না, কারণ মুরগির মাংস দুর্ভাগ্য বয়ে আনে। বিলার্দো ফুটবলারদের গোরুর মাংস খাওয়াত, তা সৌভাগ্য কতটা নিশ্চিত করত জানি না, তবে শরীরে ইউরিক অ্যাসিড অবশ্যই বাড়াত। মিলানের মালিক সিলভিয়ো বার্লুসকোনি ক্লাবের চিরাচরিত গান ‘মিলান, মিলান’ নিষিদ্ধ করে দেয়। কেননা, ওতে এক ধরনের অনিষ্টকারী কম্পন তৈরি হয়, যা খেলোয়াড়দের পা অসাড় করে দেয়। ১৯৮৭-তে বার্লুসকোনি ক্লাবের জন্য নতুন গান লেখাল ‘মিলান, আছো তুমি হৃদয় জুড়ে’।

কলম্বিয়ার বিখ্যাত কৃষ্ণাঙ্গ খেলোয়াড় ফ্রেডি রিনকন ১৯৯৪-এর বিশ্বকাপে তার অনুরাগীদের প্রবল হতাশ করে। সে যেন খেলার উৎসাহই হারিয়ে ফেলেছিল। পরে আমরা জেনেছিলাম ফুটবলের প্রতি অনীহা নয়, বরং তীব্র ভয় থেকেই তার এমন হাল। রিনকন থাকত কলম্বিয়ার সৈকত শহর বুয়েনাভেনচুরায়, ওখানকার এক বাক্‌সিদ্ধ জ্যোতিষী নাকি বলেই দিয়েছিল সেবারের কাপে কী ঘটতে চলেছে। আরও আশ্চর্যের ব্যাপার হল সেই জ্যোতিষীর প্রতিটি কথাই ফলে গিয়েছিল। জ্যোতিষার্ণব রিনকনকে বলেছিল যদি সে খুব সতর্ক হয়ে না খেলে, তাহলে নাকি তার পা ভাঙবে। ‘গোটা শরীরে লাল তিলে ভরা মেয়েটার থেকে সাবধান’- বলের কথা বলতে গিয়ে রিনকনকে বুঝিয়েছিল জ্যোতিষী, আর সাবধান থাকতে হবে ‘জন্ডিসের রুগির মতো দেখতে কার্ডটা থেকে এবং রক্ত উপচোনো কার্ডটা থেকেও’- রেফারির হলুদ আর লাল কার্ডের দিকে ইঙ্গিত করে সে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল।

কাপ ফাইনালের দিন সকালে দেখা গেল ইতালিতে সব জ্যোতিষীর এক রা। তারা স্পষ্ট ভবিষ্যতবাণী করে আজ ইতালি জিতছে। "কালা জাদুর অসংখ্য অশুভ শক্তি আজ ব্রাজ়িলকে কিছুতেই জিততে দেবে না", ইতালির জাদুকরদের জাতীয় কর্মসমিতি এভাবেই সংবাদমাধ্যমকে আশ্বস্ত করেছিল। যদিও সেদিনের খেলার ফল পেশাদার জাদুকরদের সংগঠনের মর্যাদা ধুলোয় লুটিয়ে দিয়েছিল।

তাগা-তাবিজ, স্বপ্নাদ্য মাদুলি

মাঠে ঢোকার সময় অনেক খেলোয়াড়ই ডান পা-টা আগে বাড়ায়। অনেকে মাঠে ঢুকে সোজা ফাঁকা গোলের সামনে গিয়ে একটা শট নেয়, কিংবা বারপোস্টে চুমু খায়। অন্যরা কেউ কেউ আঙুলে ঘাস ছুঁয়ে নিজের ঠোঁটের সামনে তর্জনী ঠেকায়।

অনেক সময়েই দেখবেন খেলোয়াড়রা গলায় একটা মাদুলি বা তাবিজ ঝুলিয়েছে, কিংবা কব্জিতে ধাগা বেঁধেছে। যদি কারুর পেনাল্টি শট বিচ্ছিরিভাবে বাইরে যায় তাহলে নিশ্চয়ই কেউ ষড়যন্ত্র করে বলটার গায়ে থুতু ছিটিয়ে রেখেছিল। যদি একেবারে ফাঁকায় বল পেয়েও গোল করতে না-পারে তবে নিশ্চয় কোনও ডাইনি প্রতিপক্ষের গোলের দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল। আর যদি ম্যাচটা হেরেই বসে, তার মানে অবশ্যই আগের ম্যাচটা জেতার পর সে নিজের জার্সিটা কাউকে দান করে এসেছিল।

আরও পড়ুন- ১১ জন ফুটবলারকেই পাহাড়ের চুড়োয় দাঁড় করিয়ে গুলি করে মেরেছিল হিটলারের দল

আরহেন্তিনার রিভার প্লেট ক্লাবের গোলকিপার আমাদেও কারিসো পরপর আটটা ম্যাচে কোনও গোল খায়নি, কেননা অহোরাত্র সে একটা টুপি পরে থাকত। ওই টুপিটাই গোলের দত্যিকে দূরে তাড়াত। একদিন বিকেলে বোকা জুনিয়ার্সের খেলোয়াড় অ্যাঙ্খেল ক্লেমেন্তে রোখাস ওই টুপিটা চুরি করে নেয়। শিরস্ত্রাণহীন বেচারা কারিসো সেদিন দুটো গোল হজম করে, রিভার প্লেট ম্যাচটা হেরেও যায়।

বিখ্যাত হিস্পানি খেলোয়াড় পাবলো হেরনান্দেজ় কোরোনাদো বলেছিল, রিয়াল মাদ্রিদ নিজেদের পুরনো স্টেডিয়াম ভেঙে নতুন করে বানানোর পর ছ' ছ’টা বছর তারা কোনও চ্যাম্পিয়নশিপ জেতেনি, যতদিন না এক সমর্থক মাঠের ঠিক মধ্যিখানে একটা আস্ত রসুন পুঁতে দেয়। বার্সেলোনার বিখ্যাত খেলোয়াড় লুইস সুয়ারেজ় কোনও অভিশাপে বিশ্বাস করে না। কিন্তু যতবার সে ওয়াইন খেতে গিয়ে গ্লাস ভেঙেছে, তার বুঝতে ভুল হয়নি যে পরদিন দু' একটা গোল সে করবেই।

হারের অশুভ শক্তিকে নামিয়ে আনতে সমর্থকেরা মাঠে গিয়ে বিপক্ষের এলাকায় নুন ছড়ায়, তাদের ভয় দেখাতে নিজেদের এলাকায় একমুঠো গম কিংবা চাল পুঁতে দেয়। কেউ মোমবাতি জ্বালায়, কেউ আখের রস থেকে তৈরি ‘রাম’-এর মতো কোনও পানীয় উৎসর্গ করে, অনেকে আবার সমুদ্রে ফুল ছোড়ে। বহু সমর্থক নাজ়ারেথের যিশুর কাছে এবং আগুনে পুড়ে, জলে ডুবে কিংবা রাস্তা ভুল করে মারা যাওয়া মানুষের আত্মার কাছে প্রার্থনা করে নিজের দলের নিরাপত্তা চায়। অনেক জায়গায় সন্ত জর্জের বল্লম কিংবা তার আফ্রিকান যমজ ‘লোহার দেবতা’ ওগামকে খরা চোখের ড্রাগনের অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে বেশ কার্যকর বলে মনে করা হয়।

সুবিবেচিত ভঙ্গিকে সবসময়ই প্রশংসা করা হয়। ফুটবলের যেসব ভক্ত ঈশ্বরের অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত নয়, তারা গায়ে দলের পতাকা জড়িয়ে হাঁটুতে ভর করে খাড়াই ঢাল বেয়ে ওঠে, কিংবা দিনের বেশিটা সময় লক্ষ লক্ষ মন্ত্র আউড়ে যায় বিড়বিড় করে। বোতাফোগো ১৯৫৭-য় যখন চ্যাম্পিয়ন হল, তখন ডিডি ড্রেসিং রুমে না ঢুকে খেলার পোশাকেই হিউ দে জেনেইরো শহরের এ-মুড়ো থেকে ও-মুড়ো পর্যন্ত হেঁটে যায়, সে নাকি ঈশ্বরের কাছে এমনই মানত করে রেখেছিল।

কিন্তু ঈশ্বর সব সময় ভাগ্যের হাতে মার খাওয়া ফুটবলারের পাশে দাঁড়াবার সময় পান না। ১৯৩০-এর প্রথম বিশ্বকাপে মেহিকোর দলটি প্রবল বিরূপ সমালোচনার মধ্যেই খেলতে নামে। ফ্রান্সের বিরুদ্ধে ম্যাচের আগে দলের কোচ হুয়ান লুকে দে সেরাইয়োঙ্গা মন্তেভেদিয়োর টিম-হোটেলে ছেলেদের চাঙ্গা করতে গিয়ে বলেন, কুমারী গুয়াদালুপে নাকি মেহিকোর তেপেইয়াক পাহাড়ে দলের জন্য প্রার্থনায় বসেছেন। কিন্তু কুমারী গুয়াদালুপের ব্যস্ততা সম্পর্কে কোচের স্পষ্ট ধারণা ছিল না। সে ম্যাচে ফ্রান্স চার গোল মারে। বিশ্বকাপে অংশগ্রহণকারী দলগুলির মধ্যে মেহিকো সবার শেষে পড়ে ছিল।

More Articles